এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের ভর মৌসুম চলছে এখন। উপসর্গ বদলে যাওয়ায় এবার রোগীদের অনেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও বুঝতে পারছে না।
পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ছে না-এমন অসংখ্য ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতালে। এসব রোগীদের বেশির ভাগই একেবারে শেষ পর্যায়ের শক সিনড্রোম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এমনকি এ ধরনের রোগীদের মৃত্যুহারও বেশি।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা এ ধরনের প্রচুর রোগী পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
তারা উদ্বেগ নিয়ে বলেছেন, এসব রোগীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু করার থাকে না। চিকিৎসায়ও কাজ হয় না। যারা বেঁচে যান, তাদের নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
ডেঙ্গু রোগী, কিন্তু ডেঙ্গু ধরা পড়ছে না, এর কারণ কী-জানতে চাইলে এই দুই হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেছেন, ডেঙ্গু জ্বরের তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু এনএস১ পরীক্ষা করাতে হয়। কারণ এই তিন দিনের মধ্যেই ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। এরপর পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, জ্বরের তিনদিনের মধ্যে ডেঙ্গুর এনএস১ পরীক্ষা না করলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে না। কিন্তু দেখা গেল তার প্ল্যাটিলেট ও রক্তের কাউন্ট কমে যাচ্ছে, বমি হচ্ছে— তখন তাকে আমরা ডেঙ্গু রোগী হিসেবে ধরি। এ ধরনের রোগী কম নয়। মোট ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীর অর্ধেক এ ধরনের রোগী।
এই চিকিৎসক বলেন, এ ধরনের রোগীদের আমরা কিছু প্যাথলজি ও ক্লিনিক্যালি পরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করি। প্যাথলজি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা ডেঙ্গু রোগী নির্ণয় করি। যেমন- প্ল্যাটিলেট ও ডব্লিউবিসি (হোয়াইট ব্লাড সেল বা শ্বেতকণিকা) কমতে থাকে এবং হেমাটোক্রিট (পুরো রক্তে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ) ও লিভারের এনজাইম বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, ক্লিনিক্যাল উপসর্গগুলো হলো-একদম খেতে পারছে না, বমি হচ্ছে, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা, প্রেসার দ্রুত কমে যাচ্ছে। এসব পাওয়া গেলে আমরা ধরে নিই তিনি ডেঙ্গু পজিটিভ। তখন সে অনুপাতে তাকে চিকিৎসা দিই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, কিছু রোগীর ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে না, কিন্তু ডেঙ্গুর সব উপসর্গ আছে। আমাদের এখানেও এ ধরনের রোগী আসছে। আমরা প্রচুর পাই। এসব রোগীদের প্রথমে অ্যাসেসমেন্ট করি। যে অবস্থায় আসে, সে অবস্থা বুঝে চিকিৎসা শুরু করি। শক সিন্ড্রোমের রোগী হলে শকের চিকিৎসা শুরু করি। তবে এসব রোগী সরাসরি আইসিইউতে চলে যায়। এ ধরনের রোগীর মৃত্যুহারও বেশি।
এই চিকিৎসক পরামর্শ দিয়ে বলেন, যদি ডেঙ্গু জ্বর হয়, তা হলে জ্বরের তিনদিনের মধ্যেই রোগী ডেঙ্গু পজিটিভ হয়ে যায়। এই তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা এনএস১ করাতে হবে। এরপর পরীক্ষা করা হলে ডেঙ্গু ধরা নাও পড়তে পারে। অর্থাৎ ডেঙ্গু নেগেটিভ আসতে পারে। সে জন্য জ্বর হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এবার ডেঙ্গুর তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যাচ্ছে না। এবার যাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে কিংবা যারা মারা যাচ্ছে তাদের অধিকাংশই আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে কেউ প্রথমটিতে আক্রান্ত হলে খুব বেশি জটিল অবস্থা হয় না। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি খুব জটিল হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ লক্ষণ বা উপসর্গ যেমন ১০৩ থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর, শরীর ও মাথাব্যথা-এগুলোর পরিবর্তে অন্য উপসর্গ যেমন সামান্য জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি বা অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড প্রেসারে ভোগে। এ ধরনের উপসর্গ থাকায় আক্রান্ত হওয়ার পরও অনেকে বিভ্রান্ত হয় এবং পরীক্ষা করায় না।
এবারের মৌসুমে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে সমানতালে। গতকাল মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এক বছরে এই রোগে আর কখনও এত মানুষের মৃত্যু ঘটেনি।