শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১০ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা ধর্ম

যে কুকুরের কথা কোরআনে চার বার এসেছে


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ৫:০৫ : অপরাহ্ণ
এই গুহার সামনেই সেই কুকুর পাহারাই ছিল বলে ধারণা করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
Rajnitisangbad Facebook Page

পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফে আল্লাহ তাআলা বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলেছেন। এর মধ্যে একটি আসহাবে কাহফের ঘটনা। এই ঘটনার নামেই মূলত সূরাটির নাম রাখা হয়।

ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কুকুরের বীরোচিত ভূমিকার কথাও পবিত্র কোরআনে আলোচিত হয়েছে।

কুকুর পোষার ব্যাপারে ইসলামের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনে কেন কুকুরটিকে এতো গুরুত্ব দেওয়া হলো, কুকুরটি কি আসলেই জান্নাতে যাবে এবং এই কুকুরের ঘটনা থেকে আমাদের জন্য কী শেখার আছে-এসব জিজ্ঞাসা নিয়েই এই লেখা।

আসহাবে কাহফ কারা
আরবি ‘আসহাবুল কাহফ’ শব্দের অর্থ গুহাবাসী। পবিত্র কোরআনে এমন একদল যুবককে আসহাবুল কাহফ বলা হয়েছে, যারা একজন খোদাদ্রোহী অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচতে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

আল্লাহ তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় সুরক্ষা দেন এবং ৩০০ বছর পর্যন্ত তাঁদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখেন। এরপর তাদের ফের জাগিয়ে দেন এবং সেকালের মানুষের জন্য এক বিস্ময়কর ঘটনা ও নিদর্শন বানান।

সূরা কাহফের ১৪টি আয়াতে আসহাবে কাহফের আলোচনা এসেছে। সেই আলোচনায় যুবকদের সংখ্যা এবং তারা কত দিন সেই গুহায় ঘুমিয়ে ছিলেন তা এসেছে।

তবে ঘটনাটি কখন ঘটেছিল এবং কোথায় ঘটেছিল-এ ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

যুবকদের সংখ্যা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর যুগের মানুষের তিনটি মতের কথা বলা হয়েছে-তিনজন, পাঁচজন ও সাতজন।

এরপর বলা হয়েছে, আসল সংখ্যা আল্লাহই ভালো জানেন।

এ ঘটনা কখন হয়েছিল, তা নিয়েও ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো আলেম বলেছেন, ইসা (আ.)-এর জন্মের আগেই পুরো ঘটনাটি ঘটেছিল।

কেউ বলেছেন, গুহায় আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ইসা (আ.)-এর জন্মের আগের হলেও ফের জেগে ওঠার ঘটনা তাঁর জন্মের পর।

কেউ কেউ পুরো ঘটনাই ইসা (আ.)-এর জন্মের পর বলে মত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, মহানবী (সা.)-এর জন্মের মাত্র কুড়ি বছর আগেই তারা জেগে উঠেছিলেন।

তবে দাকয়ানুস নামের অত্যাচারী রোমান সম্রাটের আমলেই এ ঘটনার সূচনা বলে সকলে মনে করেন।

ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিল, তা নিয়ে দুটি মত রয়েছে। বেশির ভাগ মুফাসসির বলেছেন, ঘটনা জর্ডানের প্রাচীন নগরী পেত্রায় ঘটেছিল। কেউ বলেছেন, তুরস্কের ইজমিরে।

কুকুরটি সম্পর্কে কোরআনে যা বলা হয়েছে

আসহাবে কাহফের ঘটনায় কুকুরটির কথা মোট চারবার এসেছে।

যেমন, এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি মনে করবে—তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে-বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি গুহার দরজার সামনে তার সামনের পা দুটি প্রসারিত করে ছিল। তুমি যদি তাদের দেখতে, তাহলে অবশ্যই পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে, আর অবশ্যই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে।’ (সুরা কাহফ: ১৮)

এ আয়াতে আসহাবে কাহফের ঘটনায় কুকুরটির মূল ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। মহান আল্লাহ গুহামুখের যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, তাতে কুকুরের পা ছড়িয়ে বসে থাকা ছিল অন্যতম।

এ কারণেই কোনো কোনো মুফাসসির জন্তুটিকে কুকুর না বলে বাঘ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, কোরআনে উল্লিখিত আরবি ‘কালব’ শব্দটি বাঘ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, সেটি কুকুরই ছিল; বাঘ ছিল না।

এরপর আসহাবে কাহফের সংখ্যার আলোচনায় আরও তিনবার কুকুরটির কথা এসেছে।

যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘কিছু লোক বলবে, তারা ছিল তিনজন, চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আর কিছু লোক বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, অজানা বিষয়ে সন্দেহপূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে। আবার কিছু লোক বলবে, তারা ছিল সাতজন, আর অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলো, তাদের সংখ্যা সম্পর্কে আমার প্রতিপালকই বেশি জানেন। অল্প কয়জন ছাড়া তাদের সংখ্যা সম্পর্কে কেউ জানে না। কাজেই সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া তাদের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক করো না, আর তাদের সম্পর্কে কারও কাছে কিছু জিজ্ঞেসও করো না।’ (সুরা কাহফ: ২২)

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, দলের সদস্য যত জনই হোন, কুকুরটি যে ছিল, তাতে কারও দ্বিমত নেই।

কুকুরটি সম্পর্কে মুফাসসিরগণ যা বলেছেন
কুকুরটির গায়ের রং ও নাম সম্পর্কে তাফসিরে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। মুতাকিল বলেছেন, কুকুরটি ছিল হলুদ রঙের। কুরতুবি বলেছেন, হলুদে লালের মিশেল ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, পাথরের রঙের ছিল।

অধিকাংশ মুফাসসির কুকুরটির নাম ‘কিতমির’ বলেছেন। আলি (রা.) বলেছেন ‘রাইয়ান’। এ ছাড়া ‘তাকুর’, ‘সাহবা’, ‘কাতমুর’ ইত্যাদি নামও এসেছে।

কুকুরটি কীভাবে আসহাবে কাহফের সঙ্গে যুক্ত হলো এ বিষয়ে মুফাসসিরগণ বলেন, কুকুরটির মালিক ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। কেউ কেউ বলেছেন, সেকালের রাজার বাবুর্চি।

কৃষক হোন বা বাবুর্চি-আসহাবে কাহফের সদস্যরা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনিও তাদের সঙ্গে রওনা হন। কারণ তিনিও সত্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে কুকুরটিও তাঁদের পিছু নেয়।

কোনো কোনো তাফসিরে কুকুরটির মানুষের মতো কথোপকথনের আলাপও এসেছে।

যাই হোক, কুকুরটি যে আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন: মৃত ব্যক্তির পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করা যাবে কি?

কুকুরটি কি আসলেই জান্নাতে যাবে
তাফসিরে আবুস সউদ, তাফসিরে মাজহারি, তাফসিরে রুহুল মাআনিসহ বেশ কিছু তাফসির গ্রন্থে প্রখ্যাত তাবেয়ি খালেদ ইবনে মাদান (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আসহাবে কাহফের কুকুর জান্নাতে যাবে বলা হয়েছে।

তিনি বলেছেন, ‘আসহাবে কাহফের কুকুর ও বালআম বাউরের গাধা ছাড়া কোনো চতুষ্পদ জন্তু জান্নাতে যাবে না।’

তবে কোরআন-হাদিসে সরাসরি এ বিষয়টি উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে কোনো সাহাবির বক্তব্যও সহিহ সনদে পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া বিষয়টি যেহেতু কোনো বিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, তাই এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কোনো কিছু বলা অনুচিত।

কারণ ইসলামের সাধারণ বিশ্বাস হলো, মানুষ ও জিন জাতিই কেবল জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া সব সৃষ্টির অস্তিত্ব হিসাব-নিকাশের পর মিটিয়ে দেওয়া হবে।

তবে আসহাবে কাহফের কুকুরটি যে সম্মানিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কুকুরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন: 

তাহলে কি কুকুর পোষা জায়েজ
আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদা দেওয়া হলেও ইসলামে শখের বশে কুকুর পোষা বৈধ নয়। কারণ ইসলামে শখ করে কুকুর পালন করা নিষেধ।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর আছে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।’ (বুখারি)

তবে শিকার করা, ফসলের সুরক্ষা, পশুপাখির নিরাপত্তা, ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারা দেওয়া এবং অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য কুকুর পোষা বৈধ। (মুসলিম, তিরমিজি, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৪/২৪২)

মুফাসসিরগণ বলেন, আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদাবান সাব্যস্ত করতে ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ সেটি ছিল কৃষক বা বাবুর্চির সম্পদ সুরক্ষার জন্য পোষা কুকুর, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ নয়।

কেউ কেউ বলেছেন, কুকুরটি আসহাবে কাহফের সম্পদ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিল। ফলে তা শখের বশে পালিত কুকুর নয়।

কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, শখের বশে পালিত হলেও সমস্যা নেই। কারণ, তা ইসলামপূর্ব যুগের। তখন কুকুর পোষার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি।

সূত্র: সূরা কাহফের ৯-২৩ আয়াতের তাফসির। তাফসিরে রুহুল মাআনি, তাফসিরে জালালাইন, তাফসিরে মারেফুল কোরআনসহ একাধিক তাফসিরগ্রন্থ অবলম্বনে

আরও পড়ুন: 

অজু ছাড়া কি কোরআন স্পর্শ করা যাবে?

আজান দেওয়ার সময় মুয়াজ্জিন কানে হাত দেয় কেন? 

মহানবী (সা.) কখনো আজান দেননি কেন?

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর