চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি।
২০১৮ সালে পুলিশ চাঞ্চল্যকর এ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করে। এরপর প্রায় চার বছর কেটে গেলেও চার্জ গঠন হয়নি। বার বার পিছিয়েছে চার্জ গঠনের শুনানির তারিখ। বিষয়টিকে বাদীপক্ষের আইনজীবী ‘রহস্যজনক’ বলে মনে করছেন।
২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় দেবাশীষ নাথ দেবুসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছিলেন বন্ধন নাথ নামে এক কুয়েত প্রবাসী। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায়। দেবাশীষ নাথ দেবু হলেন বন্ধন নাথের ভাগিনা।
এ মামলার চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন-এ কে এম নাজমুল আহসান, এ টি এম মঞ্জুরুল ইসলাম, আবু নাছের চৌধুরী, মো. ইদ্রস মিয়া ও মো. জিয়া।
২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তৎকালীন পাঁচলাইশ থানার ওসি তদন্ত মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর।
শুনানির তারিখ দফায় দফায় পরিবর্তিত হওয়ায় এখনো পর্যন্ত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়নি। আগামী ৩ জুলাই চার্জ গঠনের তারিখ রয়েছে।
চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন আছে।
এ মামলার ৪ বছরেও চার্জ গঠন না হওয়ার বিষয়ে জানতে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ফোনে যোগাযোগ করা হয় পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌশুলী (পিপি) হলেন মো. তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি রাজনীতি সংবাদকের এ প্রতিবেদকের কাছে ওই মামলার নম্বর জানতে চান। তাকে মামলার নম্বর (১৭৭/২০) জানানো হলে তিনি পরদিন মামলার নথি দেখে কথা বলবেন বলে জানান।
আজ বুধবার বিকেলে পিপি তসলিম উদ্দিনকে ফোন করা হলে তিনি রাজনীতি সংবাদের কাছে এ মামলার বিষয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করেন।
তিনি প্রথমে বলেন, ‘আদালতের পেশকার আমাকে বলেছে, এটা মাদকের মামলা। আর মামলাটা অন্য পিপি দেখেন। তার নাম উত্তম দত্ত।’
মামলার নথিতে পিপি হিসেবে নিজের নাম উল্লেখ থাকার বিষয়টি অবহিত করলে তসলিম উদ্দিন সুর পাল্টে বলেন, ‘আচ্ছা আমি মামলার নথি দেখবো।’
মামলাটি নিয়ে পিপি তসলিম উদ্দিনের এমন লুকোচুরির পেছনে রহস্য আছে!
পিপি তসলিম উদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নবগঠিত কমিটির তিন নম্বর সহ-সভাপতি। আর কমিটির সভাপতি হলেন এ মামলার অন্যতম আসামি দেবাশীষ নাথ দেবু।
এক্ষেত্রে পিপি তসলিম উদ্দিন আসামি দেবাশীষ নাথ দেবুর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী।
গত ১২ জুন পিপি তসলিম উদ্দিনের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্টও দেন দেবাশীষ নাথ দেবু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি মো. ফখরুদ্দীন চৌধুরী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আসামির সঙ্গে পিপির রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকলে সেখানে প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। এখন বাদী যদি মনে করেন, ওই কোর্টে ন্যায় বিচার পাবেন না, তাহলে তিনি আমার কাছে আবেদন করলে মামলাটি অন্য আদালতে স্থানান্তর করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে নগরীর ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের পাশে পুরনো একটি ভবনসহ ১২ কাঠা জায়গা কিনেছিলেন বন্ধন নাথ। এরপর তিনি ওই ভবনটি ভাড়া দেন। আত্মীয়তার সুবাদে দেবাশীষ নাথ দেবুকে ওই ভবনে আশ্রয় দেন বন্ধন নাথ। কিন্তু সেখানে আশ্রয় পেয়ে রাতারাতি রূপ পাল্টে ভবনটির মালিক বনে যান দেবু! ভবনটির নাম দেন ‘দেব ভবন’। ভবনের ৩০টি কক্ষের ভাড়ার টাকা তিনি নিজের পকেটে ভরতেন।
প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের টাকায় কেনা জায়গাটি নিজের নিকটাত্মীয় ‘দখল করে ফেললে’ মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে বন্ধন নাথের।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বন্ধন নাথ সেই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেড’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্র করেন। পরদিন তিনি ডেভেলপার কোম্পানিকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিতে গেলে তাতে বাধ সাধেন দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা। তারা বন্ধন নাথকে ভবনটির ভেতর আটকে রাখেন। এরপর তার কাছে তারা ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু তিনি চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা তাকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে বন্ধন নাথের পিঠের ডান পাশে গুলি করা হয়।
এরপর তারা ব্যবসায়িক লেনদেন বাবদ বন্ধন নাথের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওনা আছে বলে জোরপূর্বক তিনটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।
এ ঘটনার তিনদিন পর বন্ধন নাথ প্রাণনাশের হুমকির ভয়ে আসামিদের ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। আতঙ্কিত হয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি দেশ ছেড়ে কুয়েত চলে যান।
কিন্তু ৭০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েও ক্ষান্ত হননি আসামিরা। দুই বছর পর ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেড ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি যখন ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন, তখন দেবুর নেতৃত্বে অন্য আসামিরা আবার সেখানে গিয়ে হানা দেন। নির্মাণ কাজে বাধা দিয়ে তারা আরও ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর সাগরিকা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দেবাশীষ নাথ দেবু ও এ টি এম মঞ্জুরুল ইসলাম। কিন্তু গ্রেপ্তারের মাত্র ১৬ দিনের মাথায় তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।
গ্রেপ্তারের পর ওই বছরের ১৮ মার্চ জেলগেটে দেবাশীষ নাথ দেবু ও মঞ্জুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ালী উদ্দিন আকবর।
জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের ৫ মে আসামি দেবাশীষ নাথ দেবু ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেডের কাছ থেকে একটি চেকে ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। সেই চেকটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী প্রাইম ব্যাংক শাখায় তার ব্যক্তিগত একাউন্টে (হিসাব নম্বর: ১৩৬২১০৮০০০১৫১৮) জমা হয়।
এ মামলার দণ্ডবিধির ৩৮৫ ধারায় বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি বলপূর্বক কোনো ব্যক্তিকে জখম করে বা জখম করার ভয় দেখিয়ে মূল্যবান সম্পদ আদায় করে, সেই ব্যক্তি জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ১৪ বছর থেকে সর্বনিম্ন ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।’