২০২১ সালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (চসিক) মেয়রের চেয়ারে বসার স্বপ্ন দেখেছিলেন বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন কেড়ে নেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। সাড়ে তিন বছর পর ছিনতাই হওয়া সেই স্বপ্ন যেন ডা. শাহাদাতের হাতের মুঠোয় ধরা দিলো!
আদালতের সিঁড়ি বেয়ে আগামী ৩ নভেম্বর চসিক মেয়র হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন ৫৮ বছর বয়সী চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন। এর মাধ্যমে এক সময়ের এই ছাত্রনেতা চট্টগ্রাম সিটির ৬০ লাখ মানুষের নগরপিতা হিসেবে দায়িত্ব নেবেন।
আদালতের সিঁড়ি বেয়ে মেয়র হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি যখন আদালতে মামলা করেছিলাম, তখন আমার মনে বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন আমি ন্যায় বিচার পাবো। শেষ পর্যন্ত আমি আল্লাহর রহমতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। তবে এতো সহজে যে ন্যায় বিচার পাবো তা কল্পনা করিনি। আসলে আল্লাহ যাকে উপরে উঠাতে চায়, তাকে কেউ রুখতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, শুধু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নয়, গত ১৬ বছর শেখ হাসিনার আমলে যেসব নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটি বৈধ ছিল না। নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে প্রতিটি নির্বাচনে তারা জালিয়াতি করেছে। মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করেছে।’
জানা গেছে, আইনগত জটিলতার কারণে নগরপিতার আসনে মেয়র হিসেবে না বসে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো ডা. শাহাদাতকে। কিন্তু প্রশাসক হওয়ার ‘প্রস্তাব’ তিনি ফিরিয়ে দেন। মেয়রের চেয়ারে বসতে শাহাদাতের মনের ভেতর যেন জেদ কাজ করেছে! শেষ পর্যন্ত মেয়র হিসেবেই ডা. শাহাদাতের হাতে চট্টগ্রাম সিটির অভিভাবকের দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামসহ ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে অপসারণের আগে চসিকের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা রেজাউল করিম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে যান। ওই দিনই চসিকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলামকে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের সময় হামলা, গোলাগুলি, প্রাণহানি ও ক্ষমতাসীনদের শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে। এতে ভোটের উৎসব অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। ভোটগ্রহণ শেষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৭৫৯ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
নির্বাচনে রেজাউলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়রপ্রার্থী শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়েছেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
জানা গেছে, ডা. শাহাদাত হোসেন তৎকালীন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের কাছে প্রতিটি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফলের ইভিএমের প্রিন্ট করা কপি চান। কিন্তু তিনি ডা. শাহাদাতকে ফলাফলের প্রিন্ট কপি দেননি।
এরপর ডা. শাহাদাত আদালতের দ্বারস্থ হন। ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল বাতিল চেয়ে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা ঠুকে দেন। মামলায় তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমসহ ৯ জনকে বিবাদী করা হয়।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, নৌকা প্রতীক পাওয়ার পর থেকে চসিক কর্মকর্তারা রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, নির্বাচনের নামে ওইদিন শুধু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। কোনো কেন্দ্র থেকে ইভিএমের ফলাফলের প্রিন্ট কপি দেওয়া হয়নি। ভোটের দিন দুপুর পর্যন্ত ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোট পড়ে। কিন্তু ভোটের হিসাবে দেখানো হয়, ২২ শতাংশ ভোট পড়েছে।
মামলার এজাহারে ডা. শাহাদাত আরও অভিযোগ করেন, তিনটি ভোটকেন্দ্রে তার শূন্য ভোট দেখানো হলেও তিনদিন পর ২৮টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট দেখানো হয়, যা অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়।
নির্বাচনের সাড়ে তিন বছর পর গত ১ অক্টোবর এ মামলার রায়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণা বাতিল করে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে চট্টগ্রামের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। এরপর গত ৮ অক্টোবর ডা. শাহাদাত হোসেনকে সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত করে সংশোধনী গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
আদালত হয়ে নির্বাচন কমিশনের গেট পার হওয়ার পর ডা. শাহাদাতের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন। গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০২৪ (সংশোধন) এর ১৩ (ক) প্রয়োগ করে মেয়রদের অপসারণের একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ওই প্রজ্ঞাপনের ৩ নম্বর ক্রমিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এই প্রজ্ঞাপন ডা. শাহাদাতের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মেয়রের পদ নিয়ে আইনি জটিলতা দেখা দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি মহল থেকে ডা. শাহাদাতকে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ডা. শাহাদাত তা মেনে নেননি। এরপর ওই প্রজ্ঞাপন সংশোধনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট সভায় পাঠানো হয়। সভায় প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে ডা. শাহাদাতকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এরপর প্রজ্ঞাপনের ক্রমিক নম্বর ৩ (চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র) বিলুপ্ত করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘মেয়রের পদ নিয়ে আইনি জটিলতা দেখা দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি মহল থেকে আমাকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু আমি তা মেনে নেয়নি। আমি ওই মহলকে বলেছি, যেহেতু মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছি, আদালতও আমাকে মেয়র হিসেবে রায় দিয়েছেন তাই আমি মেয়র হিসেবেই চেয়ারে বসবো। শেষ পর্যন্ত আমাকে মেয়র করার জন্য প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা হয়।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে আইনের মারপ্যাঁচে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাতকে আটকে দিতে পারতো। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কেবিনেট সভায় প্রজ্ঞাপন সংশোনের বিষয়ে কোনো উপদেষ্টা ডা. শাহাদাতকে নিয়ে আপত্তি করেননি। বরং সততা ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির জন্য তার প্রশংসা করেছেন অনেক উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘সরকারের উপদেষ্টাদের সবাই আমাকে একজন ত্যাগী নেতা, পরিচ্ছন্ন ও শিক্ষিত রাজনীতিবিদ হিসেবে চেনে। আমি তো কখনো নোংরা রাজনীতি করিনি। এর বাইরে তারা হয়তো চট্টগ্রাম শহরের গুরুত্ব বিবেচনা করে কাজের গতির জন্য আমাকে মেয়রের দায়িত্ব দিয়েছেন।’
রাজশাহী সিটির মতো চট্টগ্রাম শহরকে সাজাতে চান ডা. শাহাদাত
রাজশাহী নগরীর প্রধান সড়কগুলো চার লেনের। ফুটপাত ও সড়ক বিভাজনে রয়েছে নানা প্রজাতির বাহারি গাছপালা। চওড়া ফুটপাতগুলো দিয়ে সহজেই পথ চলাচল করেন নগরবাসী। প্রতিটি সড়ক ও ফুটপাত ঝকঝকে তকতকে। রাতের নগরীও সৌন্দর্যময়। রাতে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে জ্বালানো হয় লাল, নীল ও হলুদ রঙের বাতি। পাড়া-মহল্লাসহ কোথাও ময়লা-আর্বজনার স্তূপ জমা থাকে না। নির্মল বায়ুর শহর হিসেবে দৃষ্টিনন্দন এই নগরী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
চট্টগ্রাম রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়রের চেয়ারে বসার আগে ডা. শাহাদাত হোসেন সবুজ, সুন্দর ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নগরী রাজশাহী ঘুরে এসেছেন। গত ২৩ অক্টোবর তিনি রাজশাহী গিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন। নগর ভবনে গিয়ে প্রশাসক ও পরিচ্ছন্ন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
এ বিষয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘রাজশাহী নগরী ছোট হলেও এই শহরের সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। রাজশাহী শহরকে কীভাবে এতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছে তা জানতে নগর ভবনে গিয়ে প্রশাসক ও পরিচ্ছন্ন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অভিজ্ঞতা শুনেছি। রাজশাহীর মতো চট্টগ্রামকে আমি পরিচ্ছন্ন ও সৌন্দর্যের নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে ডা. শাহাদাত হোসেন ৩ নভেম্বর শপথ নিলে তিনি মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন ১৫ মাস ৮ দিন। এই ১৫ মাসে ৫০০ কোটি টাকা ঋনের ভারে জর্জরিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে পরিচালনা করা ডা. শাহাতাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন: ৬ কোটি টাকার মালিক চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি