প্রকাশের সময় :২৩ অক্টোবর, ২০২৩ ৯:৩০ : পূর্বাহ্ণ
‘পানি নিয়ে ভাবনা আর না, আর না’-৯০ দশকে বিটিভিতে পেডরোলো পাম্পের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ছিল এটি। এই বিজ্ঞাপনের পর দেশের বাজারে পেডরোলো পাম্পের নাম ছড়িয়ে পড়ে। পেডরোলো হলো ইতালির একটি ব্র্যান্ডেড কোম্পানি। ১৯৮৫ সালে ইতালিতে গিয়ে বাংলাদেশের বাজারে পেডরোলো পাম্প নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রামের স্বনামধন্য শিল্পপতি নাদের খান। তার হাত ধরেই দেশের বাজারে পেডরোলো পাম্প জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে।
১৯৮৭ সালে পেডরোলো নাদের খানকে বাংলাদেশে সোল ডিস্ট্রিবিউটর (বিক্রয় পরিবেশক) হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর পেডরোলোর সঙ্গে যুক্ত করেন তার নিজের নামের দুটি অক্ষর-এন কে, যার অর্থ-নাদের খান। পেডরোলো এনকে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে ওয়াটার পাম্প শিল্পে যাত্রা শুরু করেন তিনি।
চট্টগ্রামের বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ীর উত্থান হয়েছে খাতুনগঞ্জ থেকে। কিন্তু নাদের খানের উত্থান হয়েছে জুবিলি রোড থেকে।
সততাকে পুঁজি করে উদ্যম, প্রচেষ্টা ও শ্রম দিয়ে মাত্র এক বছরের মাথায় পেডরোলো পাম্পকে বাংলাদেশের বাজারে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এই ব্যবসায়ী। তখন তার বয়স ছিল ৪০ বছর।
অথচ এই ব্যবসা শুরু করার সময় পাম্প সম্পর্কে নাদের খানের কোনো ধারণাই ছিল না! এমনকি ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম যখন ইতালি থেকে পেডরোলো পাম্প নিয়ে এসেছিলেন, তখন সেই পাম্পের নামও জানতেন না।
নাদের খান তার জীবনের পর্ব শুরু করেছিলেন একেবারে শূন্য থেকে। এখন ৬০ কোটির সাম্রাজ্য চালান চট্টগ্রামের এই শিল্পপতি।
অথচ স্কুল ও কলেজ জীবনে ছাত্র হিসেবে খুব বেশি মেধাবী ছিলেন না নাদের খান। বিএসসিতে পেয়েছিলেন তৃতীয় বিভাগ। পড়াশুনা শেষে বেকার ছিলেন। হন্যে হয়ে চাকরির পেছনে ছুটেছিলেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি পাননি। চাকরি না পেয়ে ঠিকাদারিও করেছিলেন। পরে ঠিকাদারি ছেড়ে নামেন ব্যবসায়। খাতুনগঞ্জে গিয়ে ইমপোর্ট ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে সেখান থেকে জুবিলি রোডে চলে আসেন।
এরপর নামলেন ইনডেন্টিং ব্যবসায় (নিজস্ব বিনিয়োগ ছাড়াই অন্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্যদ্রব্য এনে বিক্রির ওপর কমিশন নেওয়া)। আর এতেই বাজিমাত। এই ব্যবসার মাধ্যমে ইতালিতে গিয়ে কপাল খুলে যায় তার। এরপর পেডরোলোর হাত ধরে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছেন তিনি।
পাম্পের ব্যবসায় সফল হওয়ার পর নাদের খান পা বাড়ান চা ব্যবসায়। ফটিকছড়িতে বাগান কিনে চা উৎপাদনে যুক্ত হন তিনি। চা ব্যবসায়ও বাজিমাত। তার হালদা ভ্যালি চা বাগানটি দেশের সেরা চা বাগানের একটি।
নাদের খানের আরও বেশ কিছু ব্যবসায়িক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম ক্লাবের চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই শিল্পপতি চলতি বছর (২০২২-২০২৩ করবর্ষ) সেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন।
নাদের খানের বাবা সৈয়দ আহমদ কন্ট্রাকটার মিয়ানমারের রেংগুনে ব্যবসা করতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি তার বাবার সঙ্গে রেংগুনে চলে গিয়েছিলেন। তবে ১০ মাস পর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
নাদের খানের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। তবে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন চট্টগ্রাম নগরীর পূর্ব নাছিরাবাদ এলাকায়। তার সহধর্মিনী হাসিনা খান, দুই ছেলে-ইমরান খান ও শামিম খান এবং মেয়ে সৈয়দা তাসনুভা খানম পেডরোলো এনকে লিমিটেডের পরিচালক।
নাদের খানের বয়স এখন প্রায় ৭৯ বছর। বয়স ৭৯-এর কোটায় হলেও মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি আর মনে অনিঃশেষ প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করেন তিনি। এই বয়সেও প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা অফিস করেন তিনি। কথা বলেন সোজাসাপ্টা, কাজ করেন শান্ত আর ধীরস্থিরভাবে।
গত ২ অক্টোবর নগরীর জুবিলি রোডে পেডরোলো প্লাজার নিজ অফিসে রাজনীতি সংবাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে আজকের এ পর্যায়ে আসার অভিজ্ঞতা ও দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেন নাদের খান। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজনীতি সংবাদের সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সায়েম।
রাজনীতি সংবাদ: আপনার শিক্ষাজীবন কেমন ছিল?
নাদের খান: আমি ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলাম না। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে ফেল করেছিলাম। তখন সেখান থেকে আমাকে মুসলিম হাই স্কুলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ১৯৬১ সালে এসএসসি পাশ করি। এরপর ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএসসিতে তৃতীয় বিভাগে পাশ করেছি। বিএসসি পাশ করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে লাহোর ইঞ্জিনিয়ার ইউনিভার্সিটিতে মাইনিং (খনিজ সম্পদ উত্তোলন, অনুসন্ধান, বন্টন ও পরিবহন পরিকল্পনা) বিভাগে ভর্তি হই। তখন লাহোর ইউনিভার্সিটিতে মেধাবী ছাত্ররা ভর্তি হতেন। কিন্তু আমি সেখানে ভর্তি হই পূর্ব পাকিস্তানের কোটায়। কিন্তু আমি সেখানে এক বছর পড়ার পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। প্রথম বর্ষ শেষে আমি লাহোর থেকে চলে আসি। এতে আমার বড় ভাইয়েরা ক্ষুদ্ধ হয়, আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এরপর বেকার হয়ে পড়ি।
প্রশ্ন: কতদিন বেকার ছিলেন? চাকরি কিংবা ব্যবসা করার জন্য চেষ্টা করেননি?
উত্তর: আমার কলেজ জীবনের একজন বন্ধু ছিল, তার নাম মোখলেসুর রহমান। যিনি এখন সিএনজি অটোরিকশার সোল ড্রিস্ট্রিবিউটর (বিক্রয় পরিবেশক) উত্তরা মোটর্সের প্রতিষ্ঠাতা। তার বাসায় তখন আমার বেকার সময় কাটতো। তখন চাকরির জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিই। কিন্তু চাকরি হয়নি। আমার বড় বোনের জামাই ডা. জামাল উদ্দিন ইউসুফ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা স্টিল মিলের চিফ মেডিকেল অফিসার ছিলেন। আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে স্টিল মিলের আমিনুল ইসলাম নামের একজন ইঞ্জিনিয়ারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৯ সালে তিনি স্টিল মিল ছেড়ে পতেঙ্গায় সিমেন্ট ক্লিংকারে (বর্তমান রুবি সিমেন্ট) জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। আমি তার কাছে একদিন গিয়ে বললাম, ‘আমি তো বেকার, আমাকে কিছু কাজ দেন।’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার অফিসে পেইন্টিংয়ের কাজ করবো, তুমি টেন্ডার দাও।’ আমার ঠিকাদারি কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। আমার বড় বোনের দেবরের চন্দনপুরায় একটা প্রেস ছিল। উনার কাছে গিয়ে বিষয়টি বললাম। উনি আমাকে তার প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়ে একটা প্যাড ছাপিয়ে দিলেন। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘খান কো’। এরপর আমি টেন্ডার দিলাম। কাজও পেয়ে গেলাম। ১০ হাজার টাকার কাজ। কিন্তু আমার হাতে কাজ করার জন্য টাকা ছিল না। তখন আমার মা আমাকে ৫ হাজার টাকা দেন। কিন্তু তখন আমার লোকবল ছিল না। চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি, কাজ কীভাবে শেষ করবো। তখর আমার বাবা ছিলেন মিয়ানমারের রেংগুনে। তিনি সেখানে ব্যবসা করতেন। আমার বাবার সঙ্গে একজন সুপারভাইজার ছিলেন। আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমার কাজ করে দিতে রাজি হলেন। দুই মাসের মধ্যে কাজ শেষ করি। দুই মাস পর কাজ শেষে টাকা পাই। ২ হাজার টাকা লাভ হয়েছিল। যা আমার জীবন প্রথম ইনকাম। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আবার বেকার হয়ে পড়লাম।
প্রশ্ন: যুদ্ধের পর কী করলেন?
উত্তর: আমার বন্ধু মোখলেসুর রহমান আমাকে ইমপোর্ট ব্যবসায় নামতে পরামর্শ দিলো। আমি বললাম, ‘আমার টাকাও নেই, ইমপোর্ট ব্যবসাও বুঝি না, কেমনে করবো?’ সে আমাকে বললো, ‘চিন্তা করিও না, আমি সহযোগিতা করবো।’ এরপর ১৯৭২ সালে আমি ইমপোর্ট ব্যবসায় নামি। খাতুনগঞ্জে একটি অফিস নিই। কিন্তু ব্যবসায় ধাক্কা খেয়ে খাতুনগঞ্জ থেকে চলে আসি।
প্রশ্ন: কেন খাতুনগঞ্জ ছেড়ে চলে এসেছিলেন?
উত্তর: আমি জাপান থেকে ১২০০ পিস রাবার সলিউশন (গাম) ইমপোর্ট করেছিলাম। প্রতি পিস ২৩ টাকা খরচ পড়ে। কিন্তু বাজারে ব্যবসায়ীরা দাম বলে ২২ টাকা। তখন আমি রাগ করে বিক্রি না করে এগুলো রেখে দিই। এক সপ্তাহ পর দাম উঠে ২৪ টাকায়। কিন্তু আমি তাতেও বিক্রি করতে রাজি হয়নি। আরও এক সপ্তাহ পর দাম উঠে ৬২ টাকায়। তখন আমি ১ হাজার পিস বিক্রি করে দিই। আরও বাড়তি দামের আশায় বাকি ২০০ পিস রেখে দিই। কিন্তু পরে এগুলো বিক্রি করতে হয়েছে প্রতি পিস ১৫ টাকা দরে। তখন বুঝলাম, খাতুনগঞ্জে ব্যবসা করা ঝুঁকিপূর্ণ। এই জায়গাটা আমার জন্য উপযুক্ত নয়।
প্রশ্ন: খাতুনগঞ্জ থেকে এসে কী করলেন?
উত্তর: খাতুনগঞ্জ থেকে জুবিলি রোডে চলে আসলাম। তখন আমি আর্থিক সংকটে পড়ে যাই। জুবিলি রোডে ম. ফারুকী নামের এক উর্দুভাষী ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি আমাকে ইনডেন্টিং ব্যবসা শুরু করার প্রস্তাব দিলেন। আমি তাতে রাজি হলাম। তিনি ৭ দিনের মধ্যে ইনডেন্টিং লাইসেন্স বের করলেন। এরপর আমরা ইতালি থেকে স্টেবিলাইজার, জার্মানি থেকে ওয়েল্ডিং ব্রাশ, রড এবং জাপানের ব্রিজস্টোন থেকে ব্র্যান্ড টায়ার আনতাম। বেশ ভালো লাভ হতে থাকে। এরপর একদিন রেডিও ভিশনের (রেফ্রিজারেটরের দোকান) মালিক শামসুল আলম চৌধুরী আমাদের কাছে এসে অনুরোধ করলেন, যেন ইউরোপ থেকে ভালো হাউসহোল্ড এপ্লাইন্স কোম্পানির ফ্রিজ এনে দিই। অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর ইতালির ‘ইগনিজ’ নামের একটি কোম্পানি থেকে আমরা তার জন্য দুটি ফ্রিজ এনে দিই। এভাবে আমাদের ইনডেন্টিং ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল।
প্রশ্ন: ইতালির পেডরোলো কোম্পানির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে হলো?
উত্তর: রেডিও ভিশনের জন্য ইতালির ‘ইগনিজ’ কোম্পানি থেকে ফ্রিজ আনার পর পেডরোলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৮৫ সালে ‘ইগনিজ’ নামের ওই কোম্পানির আমন্ত্রণে আমি ইতালির মিলান শহরে একটি মেলায় যোগ দিতে যাই। মেলায় গিয়ে পেডরোলো পাম্পের স্টলে ঢুকি। এরপর আমি ১০০ পিস পাম্পের অর্ডার দিই।
প্রশ্ন: তখন তো আপনি পাম্পের ব্যবসা করতেন না। মেলায় গিয়ে কেন পেডরোলোর পাম্প অর্ডার করলেন?
উত্তর: আমি পাম্পের ব্যবসা তো দূরের কথা, পাম্প সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। ওই সময় জুবিলি রোডে মেশিনারিজ দোকানে পাম্প বিক্রি হতো। তাই কৌতূহল থেকে মেলায় পেডরোলো পাম্পের স্টলে যাই। সেখানে বনি নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি। পাম্প দেখার চেয়ে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে আমার বেশ ভালো লাগে। পেডরোলোতে চাকরি নেওয়ার সময় ওই ভদ্রলোক ফেরারি নামের একটি কার কোম্পানিতে সেলসম্যান ছিলেন। সে সময় তিনি পেপারে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল-‘আমি ফেরারি কার কোম্পানিতে কাজ করি। আমি ভালো ইংলিশ জানি, বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে। যে কেউ আমাকে চার ঘণ্টা কাজের জন্য নিয়োগ দিতে পারবেন।’ তখন পেডরোলো তাকে চার ঘণ্টার জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট দেয়। তিনি এখন পেডরোলোর এক্সপোর্ট ম্যানেজার। তখন আমি তার সঙ্গে কথা বলে ১০০ পিস পাম্পের অর্ডার দিই। পেডরোলো তখন খুবই ছোট একটি কোম্পানি ছিল।
প্রশ্ন: ইতালি থেকে তখন প্রথমবারের মতো দেশে পেডরোলো পাম্প এনে কেমন সাড়া পেলেন?
উত্তর: ইতালি থেকে দেশে এসে এলসি খুললাম। কিন্তু কাস্টমসের হয়রানির শিকার হয়েছিলাম। কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা পাম্প সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তিনি আড়াই মাস আমার পাম্পগুলো আটকে রাখে। পরে কাস্টমসের একজন যুগ্ম কমিশনার তাদের ভুল বুঝতে পারে। কাস্টম থেকে রিলিজ হওয়ার পর এসব পাম্প বিক্রি করলাম। কাস্টমারদের রিপোর্ট নিয়ে দেখি, পারফরম্যান্স খুব ভালো।
প্রশ্ন: ইতালি থেকে পাম্প এনে প্রথমবারই বাজিমাত করলেন। এরপর কী করলেন?
উত্তর: পরে আরও ৪০০ পাম্পের অর্ডার দিলাম। এসব পাম্প ১৬ লাখ টাকা দিয়ে একজন ক্রেতাই নিয়ে গেলো। আমার ৪ লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর আরও ২ হাজার পাম্পের অর্ডার দিলাম। কিন্তু এবার তেমন বিক্রি হয়নি। এরপর আমি ঢাকায় গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে ডিলার নিয়োগ দিলাম। নতুন উদ্যোমে ব্যবসা শুরু করলাম। ব্যবসার পরিধি আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো।
প্রশ্ন: ৯০ দশকে বিটিভিতে পেডরোলোর একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হতো-‘পানি নিয়ে ভাবনা আর না, আর না’। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেই কি বাজারে পেডরোলো পাম্পের নামটা ছড়িয়ে পড়েছিল ?
উত্তর: হ্যাঁ, টেলিভিশনে এই বিজ্ঞাপন প্রচারের পর দেশে পেডরোলো পাম্পের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে টিভিতে পেডরোলো পাম্পের এই বিজ্ঞাপন প্রচার হয়েছিল। এই বিজ্ঞাপন প্রচারের মাস খানেক পর বাজারে পেডরোলো পাম্পের চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। আমাদের ব্যবসা তুঙ্গে উঠে। বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে পাম্প বিক্রি হতো প্রতি মাসে ১৫০০ পিস। আর বিজ্ঞাপন প্রচারের পর বিক্রি বেড়ে যায় দ্বিগুণ । প্রতি মাসে ৩ হাজার পিসের ওপর বিক্রি হতে থাকে। এরপর দূরন্ত গতিতে বিক্রি বাড়তে থাকে। ২০০২ সালে এক বছরে ৭৮ হাজার পাম্প বিক্রি হয়েছিল। ১৯৮৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার ১৬০টি দেশের মধ্যে আমি পেডরোলোর সর্বোচ্চ ক্রেতার খ্যাতি অর্জন করি।
প্রশ্ন: ইতালিতে এখন কী পরিমাণ পেডরোলো পাম্প তৈরি হয় এবং বিশ্বের কয়টি দেশে এটি রপ্তানি হয়?
উত্তর: ইতালিতে পেডরোলো এখন প্রতিদিন ১৩ হাজার পাম্প তৈরি করে। যা বিশ্বের ১৬০টি দেশে রপ্তানি করা হয়।
প্রশ্ন: দেশের বাজারে এখন পেডরোলো পাম্পের চাহিদা কেমন?
উত্তর: দেশের বাজারে এখন চীনের পাম্পের গুনগত মান ও সাশ্রয়ী দামের কারণে পেডরোলোর পাম্পের চাহিদা কিছুটা কমেছে। কাস্টমারদের চাহিদার কারণে এখন আমরা পেডরোলোর পাশাপাশি ‘বিজি ফ্লো’ নামে চাইনিজ একটি ব্র্যান্ডের পাম্পও ইমপোর্ট করি। তবে পেডরোলো প্রথমে আমাদের অন্য কোম্পানির পাম্প বিক্রির অনুমতি দেয়নি। ১০ বছর আগে আমি ইতালিতে পেডরোলের একটি কনফারেন্সে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে রাজি করাই।
প্রশ্ন: পেডরোলোর মতো একটি বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানির নামের সঙ্গে আপনার নামের দুটি অক্ষর-এন কে যুক্ত করেছেন। এতে পেডরোলো কোনো আপত্তি করেনি?
উত্তর: এটা একেবারে ব্যতিক্রম। এটা আমি পেডরোলোর সম্মতি নিয়েই করেছি। তারা কোনো আপত্তি করেনি। আর করবেই বা কেন? আমিই তো বাংলাদেশের বাজারে পেডরোলোকে দাঁড় করিয়েছি। ইতালিতে পেডরোলোর একটি এক্সপোর্ট অফিস রয়েছে, যেখানে দুটি বিজনেস কনফারেন্স হল আছে। যার মধ্যে একটি হল আমার নামে নামকরণ করা হয়েছে। ইতালি ভাষায় এই হলের নাম হলো ‘সালা নাদের’। এটা আমার জন্য অতি আনন্দের ও গৌরবের বিষয়।
প্রশ্ন: আপনি পাম্পের ব্যবসার পাশাপাশি চা ব্যবসা করেও সফল হয়েছেন। ফটিকছড়িতে আপনার হালদা ভ্যালি চা বাগানের সাফল্যের রহস্য কী?
উত্তর: ২০০৩ সালের দিকে সিলেটের এক ব্যক্তির কাছ থেকে আমি হালদা ভ্যালি চা বাগানটা কিনে নিয়েছিলাম। এটা তখন পুরোটাই পাহাড় ও জঙ্গল ছাড়া কিছু ছিল না। চা বাগান সম্পর্কে তখন আমার কোনো ধারণাই ছিল না। প্রথম বছর ১০ একর জায়গায় ৭২ হাজার চারা গাছ রোপণ করেছিলাম। কিন্তু পানির অভাবে এক বছরের মাথায় মারা যায় অর্ধেক চা-গাছ। গাছ বাঁচাতে হাসপাতালে ব্যবহৃত স্যালাইনের প্যাকেটে পানি ভরে প্রতিটি গাছের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। এতে বাগানটি একপর্যায়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে আমি থাইল্যান্ডে গিয়ে একটি ১ হাজার একরের ফলের বাগান পরিদর্শন করি। এতে ইলেকট্রিক পাম্পের সাহায্যে স্থায়ী সেচ দিতে দেখলাম। এরপর থাইল্যান্ড থেকে এসে আমি হালদা ভ্যালিতে দুটি ডিজেল পাম্প দিয়ে স্থায়ী সেচব্যবস্থা চালু করি। তখন আমাকে অনেকে পাগল বলেছিল। কিন্তু এতে আমি সফল হই।
প্রশ্ন: আপনি হালদা ভ্যালির পাশাপাশি খাগড়াছড়ির রামগড়ে ও শ্রীমঙ্গলের ফিনলে’তে চা বাগান করেছেন। আপনার এখন মোট কয়টি চা বাগান আছে আর কী পরিমাণ চা উৎপাদন হয়?
উত্তর: ২০০৪ সালে রামগড়ে চা বাগান করি। বছর খানেক পর কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথভাবে শ্রীমঙ্গলে ফিনলে চা বাগানে যুক্ত হই। এখন মোট ১৮টি চা বাগান আছে আমাদের। দেশে এখন গড়ে হেক্টরপ্রতি চা উৎপাদন হয় ১ হাজার ৫০০ কেজি। আর হালদা ভ্যালিতে চা উৎপাদন হয় হেক্টরপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ কেজি। ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন করে ‘সেরা জাতীয় পুরস্কার’ পায় আমার এই চা বাগান। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমি এই পুরস্কার গ্রহণ করি।
প্রশ্ন: আপনার প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার (লেনদেন) কত?
উত্তর: ৫০-৬০ কোটি টাকা।
প্রশ্ন: আপনি আগে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক ছিলেন। পরে মেট্টোপলিটন চেম্বারের পরিচালক হয়েছেন। চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে কি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন?
উত্তর: আমি এখন মেট্টোপলিটন চেম্বারের পরিচালক হলেও চট্টগ্রাম চেম্বারের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছি। তবে আমি মনে করি, এই দুটি চেম্বার ব্যবসায়ীদের কল্যাণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন: দেশের রিজার্ভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে চলছে ডলার সংকট। গত দুই বছরের ব্যবধানে জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাকিভাবে বেড়েই চলেছে। দেশের এই অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: সংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের চেয়ে পণ্যের দাম কম। তারা আমাদের থেকে যে ঋণ নিয়েছিল তাও যখাসময়ে পরিশোধ করে দিয়েছে।
প্রশ্ন: একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি কী পরামর্শ দেবেন?
উত্তর: সফল উদ্যোক্তা হতে হলে দুটি জিনিসের প্রয়োজন-সততা ও পরিশ্রম। এটা যারা করতে পারবে তাদের দুটি জিনিসের অভাব হবে না। ভাতে-পানিতে কষ্ট পাবে না আর ইজ্জতে কষ্ট পাবে না। একটা মানুষের জীবনে আর কী দরকার? আমার যে লক্ষ কোটি টাকা হতে হবে তা তো না। সম্পদের মালিক আল্লাহ। আমরা হলাম কেয়ারটেকার। আমি বিএসসিতে থার্ড ডিভিশন পাশ করেছি, আল্লাহ আমাকে এতো সম্পদ কেন দিলেন, তা তিনিই ভালো জানেন।
রাজনীতি সংবাদ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
নাদের খান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন:
১ হাজার ৪৮৩ টাকায় ব্যবসা শুরু, এখন ৬ হাজার কোটি টাকার শিল্প গ্রুপ
মাসে কোটি টাকা আয় করেও ট্যাক্স দেয় না চট্টগ্রাম চেম্বার