নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও ভিটেমাটি না পেলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি নয়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ঘুরে এসে শুক্রবার রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা এ কথা বলেছেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ রাখাইন রাজ্যে ১৫টি গ্রাম প্রস্তুত করে রেখেছে এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছে।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল সেগুলো পরিদর্শন করতে আজ শুক্রবার সকালে টেকনাফ থেকে নৌপথে যাত্রা করে এবং সন্ধ্যায় ফিরে আসে। রাখাইনের পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উপযোগী কি না, মূলত তা দেখতে এই প্রতিনিধিদল সেখানে গিয়েছিল।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি শুক্রবার মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্য ঘুরে আসে।
দলটিতে তিন রোহিঙ্গা নারীসহ মোট ২০ জন রোহিঙ্গা ছিল। এ ছাড়া অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব বিশ্বজিত দেবনাথসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন।
তারা শুক্রবার সকাল ১০টায় মিয়ানমারের উদ্দেশে টেকনাফ ছাড়েন। একই দিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটিঘাটে প্রতিনিধিদলটি ফিরে আসে।
পরিদর্শন শেষে টেকনাফে পৌঁছে প্রতিনিধিদলের প্রধান মো. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “রোহিঙ্গা সমস্যার বাংলাদেশের কাছে একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দাবি বরাবরই ছিল যে, এটি যাতে স্থায়ী (সাসটেইনেবল), মর্যাদাপূর্ণ এবং কার্যকর হয়। সে নিরিখে বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল, মিয়ানমারের কাছে বরাবরই যারা প্রত্যাবাসিত হবে, সেসব রোহিঙ্গাকে যাতে তাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখানো হয়। সে নিরিখে আমরা এটির নাম দিয়েছিলাম ‘গো অ্যান্ড ভিজিট’।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই, তারা সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। আমরা মিয়ানমারের মংডুর আশপাশে যেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য যা অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে, সেগুলো ঘুরে দেখার পর ফিরে এলাম। আমাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা ছিলেন, মূলত তাদের জন্য এই আয়োজন। যারা প্রত্যাবাসিত হবে, তাদের সচক্ষে এটি দেখানো হয়েছে। মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ ব্রিফ করেছে, বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।’
মিজানুর রহমান বলেন, ‘মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ এখানে আসবে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরও কথা বলবে। সবকিছু করা তাদের কনফিডেন্স বৃদ্ধির জন্য, তাদের আশ্বস্ত করার জন্য। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল আসার পর প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। মংডু শহরে বহু রোহিঙ্গা আছে। আমি যতটুকু তথ্য নিলাম সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা ব্যবসা করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, এমনটি জানিয়েছে।’
এদিকে ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের প্রধান মোহাম্মদ সেলিম বলেন, “অনেক বছর পর আমাদের দেশ মিয়ানমার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমাদের সেখানে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকারকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা মিয়ানমার গেছি, আমাদের ক্যাম্পগুলো দেখিয়েছে। আমরা জানতে চাইলাম, ক্যাম্প কেন, কার জন্য? তারা বলেছে ‘আপনাদের জন্য’। আমরা বলেছি, আমরা যদি সিকিউরিটি না পাই, নাগরিকত্ব কার্ড না পাই তাহলে কী হবে, তখন তারা জানিয়েছে এনভিসি কার্ড নিতে হবে। আমরা বলেছি, এনভিসি কার্ড অতিথিদের জন্য, আমরা এনভিসি কার্ড নেয়া মানে আমরাও অতিথি বা মেহমানের মতো। আমরা কোনো জমির মালিক হতে পারব না, নাগরিকত্ব পাব না। আমরা দাবি করেছি, আমাদের গ্রামে আমাদের ভিটাজমি ফিরিয়ে দিতে, তখন আমরা নিজেদের টাকায় ঘর তৈরি করে থাকব। আমাদের শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটেমাটি না দিলে আমরা যাব না।”
২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সুফিয়ান বলেন, ‘সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের নাগরিকত্ব দাবি করেছি, ভিটেমাটি দাবি করেছি, সেগুলো ফেরত দিলে আমরা যাব, সেটা জানিয়েছি। আমাদের গ্রামের জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছি, কিন্তু দাবি আদায়ের আগে সেখানে যাওয়ার মতো এখনো পরিস্থিতি দেখছি না।’
গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। তারা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পে তালিকাভুক্ত ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ফিরে যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে সেনা অভিযান এবং রাখাইন প্রদেশে গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এরপর ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম সময়সীমা ঠিক হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে ঘোষণা দেয়ায় সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
২০১৯ সালের ২২ আগস্ট বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো উদ্যোগ নিলেও এ বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সর্বশেষ তৃতীয়বারের মতো সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের এই কার্যক্রম চলমান দেখে রোহিঙ্গারা অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরছে।
প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে: ইউএনএইচসিআর
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সফর সম্পর্কে অবগত থাকার কথা জানিয়েছে।
সংস্থার মুখপাত্র রেজিনা দে লা পোর্টিলা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘এই পরিদর্শনকাজের আয়োজনে ইউএনএইচসিআর যুক্ত নয়। তবে আমরা আবারও বলছি, প্রত্যেক শরণার্থীর তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন অবশ্যই স্বেচ্ছায় হতে হবে। সেটি হবে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে। মিয়ানমারে ফিরে যেতে কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করা উচিত হবে না।’