বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪ | ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ৭ জিলকদ, ১৪৪৫

মূলপাতা জাতীয়

বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১১:৩৪ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

‘বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির স্থপতি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি-সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আমি তাকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বললেও মূলত তিনি পর্দার অন্তরাল থেকে দলীয় রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দাবার চাল দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির আসনে থেকে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে ঘটনাটি ঘটান, তার নাম সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত রায়। এই রায়ের ফলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়।’

প্রয়াত বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার সদ্য প্রকাশিত ‘নির্বাচননামা: নির্বাচন কমিশনে আমার দিনগুলো’ বইতে এসব কথা লিখেছেন।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বিচার বিভাগ। গণতান্ত্রিক দেশে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে অনেক যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা যেতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য যে নতুন আইনি কাঠামোর প্রয়োজন ছিল, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে তা অনুপস্থিত। তিনি অবশ্য বলেছেন যে, এ রায়ের পর আরও দুই টার্ম জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। কিন্তু এর কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। ফলে নতুন ব্যবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রেসক্রিপশন দিয়ে পক্ষান্তরে তিনি রাজনৈতিক বিপর্যয় টেনে আনেন।’

বইতে মাহবুব তালুকদার আরও লিখেছেন, ‘যাই হোক, আমি ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রস্তাব করলাম। সবাই (সিইসিসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা) একবাক্যে বললেন, এটা হতেই পারে না। জানুয়ারিতে স্কুল খুলবে, বইপত্র দেয়া হবে। জানুয়ারির প্রথমদিকে বিশ্ব ইজতেমা আছে, তখন পুলিশ ব্যস্ত থাকবে। ড. রফিক একটা অকাট্য যুক্তি দেখালেন যে, জানুয়ারিতে উত্তরবঙ্গে ভীষণ কুয়াশা পড়ে। কুয়াশায় ব্যালট পেপারই হয়তো দেখা যাবে না।’

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার আরও লিখেছেন, ‘তাদের এসব যুক্তিতে আমি পিছিয়ে এসে ৩ জানুয়ারি ২০১৯ ভোটের তারিখ নির্ধারণের প্রস্তাব করলাম। যুক্তি দেখালাম বড়দিনের আগে-পরে ভোট না করতে খ্রিস্টান সম্প্রদায় নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু আমার যুক্তি হালে তেমন পানি পেলো না। তারা ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করার বিষয়ে যেন পণ করে বসে আছেন। আমার মনে হলো, সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো বার্তা দেয়নি তো? সম্ভবত এ কারণেই আমার সহকর্মীরা ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন করতে দায়বদ্ধ ছিলেন। ৩ ডিসেম্বর ২০১৮ দৈনিক যুগান্তর-এ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘এই ডিসেম্বরে দুটি বিজয় দেখতে চাই।’

বইতে মাহবুব তালুকদার আরও লিখেছেন, ‘ভোটের তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে সিইসি একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জানুয়ারিকে ‘ডিস্টার্বড’ হিসেবে বর্ণনা করে সিইসি বলেন, ‘আপনারা জানেন, জানুয়ারিতে বিশ্ব ইজতেমা হয়। আমি যদ্দূর জানি, ১৫ জানুয়ারি থেকে দুই দফায় হবে। ওটা যদি হয়, তাহলে ১৫ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।’ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের নামে ‘বিনা কারণে’ যাতে মামলা দেয়া না হয়, সেজন্য সে নির্দেশনা ইসি’র তরফ থেকে দেয়া হয়েছে।’’

তিনি আরও লিখেছেন, ‘সিইসি’র শেষ কথাটা আমার কাছে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘বিনা কারণে’ কাউকে মামলা দিচ্ছে না। মামলা দেয়ার জন্য কোনো না কোনো কারণ উল্লেখ করতেই হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কারণ ভুয়া। তবে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর সিইসি’র ‘বিনা কারণে মামলা না করার বক্তব্যে কিছুটা ইতিবাচক কাজ হয়েছিল। বিরোধীদের ধরপাকড় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশের থানাগুলোয় কয়েক হাজার ‘গায়েবি’ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার ‘আপাতত বন্ধ’ রাখার নির্দেশনা দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। একইসঙ্গে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেয়া হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এমন নির্দেশনার কথা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দেন। তবে এই নির্দেশ কয়েক দিন পরেই সবাই বেমালুম ভুলে গেছেন। ক্ষমতাসীন দল মামলার বদলে হামলার অপশন বেছে নেয়। বিএনপি’র মহাসচিবও এ হামলা থেকে অব্যাহতি পাননি।’

ডায়েরির পাতা, তারিখ: ৮ নভেম্বর ২০১৮ শিরোনামের লেখার প্রয়াত এ নির্বাচন কমিশনার লিখেছেন, ‘আমার মনে হয়, আমরা একটা সাজানো ছকে নির্বাচন করতে যাচ্ছি। প্রথম ছক হলো- জাতীয় সংসদ ও সংসদ সদস্যদের স্বপদে বহাল রেখে নির্বাচন করা। এটা সংবিধানসম্মত হলেও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এতে অন্য প্রার্থীদের বিষয়ে বৈষম্য তৈরি হয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আমাদের দেশে সম্ভব কিনা, জানি না। কারণ, সরকার তার দলের প্রতি পক্ষপাতশূন্য হতে পারে না। দ্বিতীয় ছক হলো- জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং অফিসার পদে নিয়োগ করা। রিটার্নিং অফিসারের মতো পদে সরকারের অনুগ্রহভোগী কর্মকর্তারা কতোটুকু নিরপেক্ষ থাকবেন, সেটা আমার জিজ্ঞাসা। তৃতীয় ছক হচ্ছে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাল্পনিক মামলা ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্বিচার গ্রেপ্তার। এ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ‘কাউকে হয়রানিমূলকভাবে গ্রেপ্তার না করার’ নির্দেশ যারা প্রতিফলন করেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো নজির নেই। এটা আমার কাছে অর্থহীন নির্দেশ মনে হয়।’

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর