শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪ | ৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১০ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা সাক্ষাৎকার

ডা. শাহাদাত হোসেনের সাক্ষাৎকার

ভোট কারচুপির মামলা করায় আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সাজানো হয়


প্রকাশের সময় :৫ জুন, ২০২১ ৭:৩০ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

এক কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলায় গত ২৯ মার্চ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বিএনপি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন। বিএনপিরই এক নারী নেত্রী তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করা নিয়ে তখন চট্টগ্রামসহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন নাসিমন ভবন বিএনপি অফিসের সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। তিনটি মামলায় ৫১ দিন কারাভোগের পর গত ১৯ মে জামিনে মুক্তি পান ৫৫ বছর বয়সী এই বিএনপি নেতা। মামলা, কারাজীবন ও সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তিনি তিনি কথা বলেছেন রাজনীতি সংবাদ এর সাথে। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজনীতি সংবাদ এর সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সায়েম।

প্রশ্ন: চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক মহিলা বিষয়ক সহ সম্পাদক ডা. লুচি খান এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি ও ‘জীবনচিত্র’ নামে একটি এনজিও’র সচিব মো. মহিউদ্দিনকে অপহরণের অভিযোগে মামলায় আপনিসহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করেছেন। গ্রেপ্তারের আগে আপনি কি এই চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে অবগত ছিলেন?

উত্তর: গ্রেপ্তারের আগে আমি বিষয়টি জানতাম না। গত ২৯ মার্চ বিকেলে পাঁচলাইশে আমার ট্রিটমেন্ট হাসপাতালের চেম্বারে ডিবি পুলিশ এসে বলে, আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে। তখন আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? তারা এর কোনো জবাব দিতে পারলো না। মনসুরাবাদ ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর টিভির স্ক্রলে দেখানো হচ্ছে, আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখন তারা আমাকে বললো, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, আমার বিরুদ্ধে কী মামলা, আমার বিরুদ্ধে তো কোনো ওয়ারেন্ট নেই। তখন তারা বললো, চকবাজার থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে আমি জানলাম ডা. লুচি খান আমার বিরুদ্ধে একটা চাঁদাবাজির মামলা করেছে। যা শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই।

প্রশ্ন: আপনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির এই অভিযোগ কি রহস্যজনক মনে করছেন?

উত্তর: রহস্যজনক তো বটেই। লুচি খান চকবাজার থানায় এ ঘটনার জিডি করে ২৪ মার্চ। আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো ২৯ মার্চ। জিডি হওয়ার পর পাঁচদিন চকবাজার থানা থেকে আমার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়নি। কোনো তদন্ত ছাড়াই আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। এটা তো হতে পারে না। এটার পেছনে তো নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে।

প্রশ্ন: এ চাঁদাবাজির ঘটনায় আপনাকে কীভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে?

উত্তর:জিডিতে উল্লেখ করা হয়, মামলার দুই ও তিন নাম্বার আসামি মোজাফফর আহমদ ও তার স্ত্রী ফাতেমা গত ২০ মার্চ নগরীর কাপাসগোলায় জীবনচিত্র এনজিও’র চেয়ানম্যান ডা. লুচি খানের অফিসে যান। তারা তার কাছ থেকে আমার নাম ভাঙিয়ে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ সময় তারা লুচি খানের কাছ থেকে জোরপূর্বক এবি ব্যাংকের চারটি চেক নেন। একপর্যায়ে তারা সেখান থেকে জীবনচিত্র এনজিও’র সচিব মো. মহিউদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যান।

প্রশ্ন: এই ঘটনার সত্যতা কতটুকু?

উত্তর: এই ঘটনা একেবারেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কেননা এ সময় দেশেই ছিলেন না মোজাফফর আহমদ। তিনি ১১ মার্চ সৌদি আরবে চলে যান। তাছাড়া জিডিতে মহিউদ্দিনকে অপহরণের অভিযোগ করা হলেও তার ফিরিঙ্গীবাজারের বাসভবনের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন তিনি বাসা থেকে বের হয়েছেন ও ফিরেছেন। এ সময় তার সাথে বোরকা পরা লুচি খানকেও দেখা গেছে। আর অপহরণের ঘটনা ঘটলে তো আগে মহিউদ্দিনের স্ত্রী কিংবা তার ভাই থানায় তাৎক্ষণিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করার কথা। চার দিন পর লুচি খান কেন থানায় জিডি করেছেন?

প্রশ্ন: মোজাফফর আহমদের সাথে লুচি খান ও মহিউদ্দিনের কী সম্পর্ক এবং এই ঘটনার সাথে আপনি কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?

উত্তর: লুচি খান ও মহিউদ্দিন জীবনচিত্র এনজিও’র মাধ্যমে কানাডায় একটা ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মোজাফফর আহমদের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা নিয়েছেন। গত বছর অক্টোবরে তারা ২২ গন্ডার একটি জমিও মোজাফফর আহমদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছিলেন। লুচি খান এই জমির মূল্য নগদ টাকা না দিয়ে চারটি চেক দিয়েছিলেন মোজাফফরকে। কিন্তু ব্যাংকে এসব চেক ডিজঅনার হয়। মোজাফফর ও তার সহধর্মিনী হলেন আমার চন্দনাইশ গ্রামের লোক এবং লুচি খান ও মহিউদ্দিন তাদের কাছে আমার পরিচয় দিয়েছিলেন। ব্যাংকে চেক ডিজঅনার হওয়ার পর মোজাফফর ও তার সহধর্মিনী হতাশ হয়ে এ ব্যাপারে আমার কাছে এসে সাহায্য চাইলেন। এরপর আমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ডিসেম্বর মাসে লুচি খানকে মোজাফফরের টাকা পরিশোধ করে দিতে বলি। কিন্তু সে মোজাফফরকে টাকা দেয়নি। এরপর আমি তাকে মোজাফফরের টাকা দিয়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করি।

প্রশ্ন: কিন্তু আপনাকে কেন মামলায় অভিযুক্ত করা হলো?

উত্তর: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি আমি চট্টগ্রাম আদালতে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের সচিব, রিটার্নিং অফিসার, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমসহ ৯ জনকে বিবাদি করে মামলা করেছিলাম। মামলায় ভোটের ফলাফলের ইভিএম প্রিন্ট কপি না দেওয়া, ৫ শতাংশ ভোটকে ২২ শতাংশ দেখানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়। এরপর ২৩ মার্চ এই মামলার শুনানি শেষে বিচারক প্রিসাইডিং অফিসারের সইসহ নির্বাচনের ইভিএমের প্রিন্ট কপি আদালতে জমা দিতে নির্বাচন কমিশনকে আদেশ দেন। এই মামলা করার কারণে প্রতিপক্ষ পরিকল্পিতভাবে লুচি খানের সাথে যোগসাজেশ করে আমার বিরুদ্ধে এই চাঁদাবাজির অভিযোগ সাজিয়েছে।

প্রশ্ন: প্রতিপক্ষ বলতে আপনি কাকে বুঝাচ্ছেন?

উত্তর: যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেনিফিশিয়ারি হলেন মেয়র রেজাউল করিম সাহেব। তাকেই আমি সন্দেহ করছি। কারণ আমি গ্রেপ্তার হওয়ার ৭ দিন পর ডা. লুচি খান সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে গিয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

প্রশ্ন: আপনার সাথে লুচি খানের যে অভ্যন্তীণ বিরোধ সেটা মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী কীভাবে জানলেন?

উত্তর: আমি নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি ২২ ফেব্রুয়ারি। এর একমাস পর লুচি খান থানায় অভিযোগ করেছে। লুচি খানকে আমি নির্বাচনের পরেও বারবার চাপ প্রয়োগ করেছি মোজাফফর আহমদের টাকা পরিশোধ করার জন্য। অন্যথায় তাকে দল থেকে বহিস্কার করবো বলেছিলাম। এ অবস্থায় সে আওয়ামী লীগের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সে হয়তো রেজাউল করিম সাহেবের কাছে গিয়ে বলেছে, আমি ডা. শাহাদাতের বিরুদ্ধে মামলা করবো, আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন।

প্রশ্ন: জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ডা. লুচি খানের সাথে এ ব্যাপারে আপনার কোনো কথা হয়েছে?

উত্তর: না, আমি কেন তার সাথে কথা বলবো। যার এতো উপকার করার পর আমার সাথে অন্যায় করেছে, তার সাথে কথা বলার মতো রুচি আমার নেই।

প্রশ্ন: আপনি কি লুচি খানের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবেন?

উত্তর: আমি এই মামলার পুলিশ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। আমি পুলিশ কমিশনারকে বলেছি, রিপোর্টে আমি দোষী হলে দোষী, আর নির্দোষ হলে নির্দোষ বলবে। কিন্তু যাতে দ্রুত রিপোর্টটা দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আমি পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নিবো। আমি এই মামলা নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবো। কারণ এই মিথ্যা মামলা আমার রাজনৈতিক স্ট্যাটাসে দাগ লাগিয়েছে। আমি এ নিয়ে দুইবার নির্বাচন করেছি। জেল থেকে গত সংসদ নির্বাচন করেছি। চট্টগ্রামে কোনো শিল্পপতি কি বলতে পারবে, আমি তাদেরকে ফোন করেছি? আমাকে ১০ টাকা দেন, ১ লাখ দেন। এক সময় শিল্পপতিদের কাছে রাজনীতিবিদেরা ফোন করতো। ডা. শাহাদাত কাকে ফোন করেছে, চট্টগ্রামে এরকম কোনো উদাহরণ আছে? আমি আমার নিজের উপার্জন করা টাকা দিয়ে ইলেকশন করেছি।

প্রশ্ন: গত ২৯ মার্চ নাসিমন ভবনের সামনে নেতা-কর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ কেন হয়েছিল?

উত্তর: সেদিন আমি বাসা থেকে কাজীর দেউড়ি মোড়ে এসে জানতে পারি, পার্টি অফিসের সামনে পুলিশের সাথে নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ চলছে। কী কারণে সংঘর্ষ বেধেছিল তা আমি জানতাম না। তখন আমি সেখান থেকে আমার চেম্বারে ফিরে যাই। অথচ পুলিশ এ ঘটনায় দুটি মামলায় আমাকে আসামি করেছে।

প্রশ্ন: আপনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর নাসিমন ভবনে বিএনপি কার্যালয়ে কারা তালা লাগিয়েছিল? প্রায় দুই মাস ধরে তালাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আপনি মুক্তি পাওয়ার পর সেই তালা আবার খুলে দেওয়া হয়…

উত্তর: পুলিশ তালা লাগিয়েছিল। আমি মুক্তি পাওয়ার পর সিএমপির এসবি শাখায় যোগাযোগ করে তাদের তালা খুলে দিতে বলি। এরপর তারা এসে তালা খুলে দেয়।

প্রশ্ন: ৫১ দিনের জেল জীবন কেমন কেটেছে?

উত্তর: আমি তো এর আগেও দুই বার জেল কেটেছি। আমাকে এবারও জেল কোড অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। আমার পাশের রুমে ছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের ছেলে ইয়াছিন রহমান টিটু। তাদের সাথে প্রায় সময় কথা হতো। তবে ওসি প্রদীপকে কড়া নজরদারিতে রেখেছেন কারারক্ষীরা। কারাগারে আমাদের দলের প্রায় ৭০-৮০ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন। ঈদের সময় নেতা-কর্মীদের অনেককে পাঞ্জবি-লুঙ্গি দিয়েছি। আমার পিসি কার্ড থেকে তাদেরকে মাঝে মধ্যে বাজার করে দিতাম।

রাজনীতি সংবাদ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. শাহাদাত হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর