মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪ | ১৭ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২০ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে হচ্ছেটা কী?


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ৯:০৭ : পূর্বাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

সিটি করপোরেশনকে বলা হয়ে থাকে শহরের ‘অভিভাবক সংস্থা’। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সংস্থাটি সম্প্রতি নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। গত এক মাসের মধ্যে চসিকে তিনটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে।

এর মধ্যে রয়েছে, চসিক কার্যালয়ে নিজ কক্ষে দিন দুপুরে একজন প্রকৌশলীকে পিটিয়েছেন ঠিকাদাররা। মশার ওষুধ কেনা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিতে হানা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ডে জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঠিকাদাররা গোলাম ইয়াজদানী নামে একজন প্রকল্প পরিচালককে মারধর করেন। ওই দিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে নগরীর টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে তার কক্ষেই এ ঘটনা ঘটে।

জানা যায়, ঠিকাদাররা গোলাম ইয়াজদানীর শার্টের কলার ধরে ঘুষি দেন। তারা তার শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলেন, প্যান্টের বেল্ট খুলে ফেলেন। সাহাবুদ্দিন নামে একজন ঠিকাদার তার শার্টের ভেতর থেকে রড বের করে টেবিলের কাচ ভাঙচুর করেন। একপর্যায়ে তিনি প্রকল্প পরিচালকের মাথায় রড দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করেন।

জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’। আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে।

গত বছরের ১৪ আগস্ট প্রেষণে প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৩৭টি ভাগে (লটে) ২২০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত নভেম্বরে। প্রকল্পের আওতায় ওভারপাস, রাস্তা, পথচারী-সেতু, কালভার্ট নির্মাণ, গোলচত্বরসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নকাজ হবে।

অভিযুক্ত ঠিকাদাররা এ প্রকল্পের কাজ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে গোলাম ইয়াজদানীকে মারধর করেন। এ ঘটনায় জড়িত ১০ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ওই দিন রাতে নগরীর খুলশী থানায় একটি মামলা হয়। সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে অসৎ ব্যক্তিরা অন্যায় সুবিধা নিতে না পেরে তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

এ ঘটনায় সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত ঠিকাদারদের মালিকের ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সিটি করপোরেশন।

কিন্তু মামলা ও তদন্ত কমিটি গঠন হলেও এ ঘটনায় সংস্থাটির নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ের চতুর্থ তলায় প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীর দপ্তর। তাকে যখন মারধর করা হচ্ছিলো তখন কেউ এগিয়ে আসেননি। হামলাকারী ঠিকাদারদের কেউ আটকানোরও চেষ্টা করেননি।

অথচ, সিটি করপোরেশনের নিচতলায় প্রধান ফটকের সামনে নিরাপত্তারক্ষীরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। দোতলায় মেয়রের কার্যালয়ের সামনেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তারক্ষী থাকেন।

সম্প্রতি মশার ওষুধ কেনা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে। দরপত্র ছাড়াই এক ছাত্রলীগ নেতার প্রতিষ্ঠান থেকে ঘুরেফিরে বারবার প্রায় ৭৮ লাখ টাকার মশার ওষুধ কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অনিয়মের তথ্য পেয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি করপোরেশনে হানা দেয় দুদক।

অভিযানকালে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দুদক দেখতে পায়, বেআইনিভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেঙ্গল মার্ক ইন্টারন্যাশনাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ দফায় মোট ৭৭ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ টাকার মশার ওষুধ ক্রয় করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী হলেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক অরভিন সাকিব ইভান।

জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে চসিকে। গত ২২ জানুয়ারি চসিকের জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। নগরীর ৫টি ওয়ার্ডের আইডি ব্যবহার করে সার্ভারে ঢুকে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করেছে হ্যাকাররা।

এরমধ্যে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ৪০৮টি, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের ৮৪টি, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের ৪০টি, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ১০টি এবং ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের ৪টি।

সনদ জালিয়াত চক্র শনাক্তে অভিযানে নামে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তারা চারজনকে আটক করে।

এসব ঘটনার পর সিটি করপোরেশনে এখন অস্থিরতা বিরাজ করছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নগরীর টাইগারপাস চসিক কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘প্রকৌশলীকে মারধরের পর অভিযুক্ত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। মামলা হয়েছে, অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর এখানে যে কোনো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদক আসতেই পারে। কিন্তু মশার ওষুধ কেনা নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। আর জন্মনিবন্ধন সনদের সার্ভার হ্যাক করার বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন দায়ী নয়। কারণ সার্ভার আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না। এসব ঘটনায় সিটি করপোরেশনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে বলে আমি মনে করি না।’

নগরীর সচেতন নাগরিকরা বলছেন, সিটি করপোরেশনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠানটিতে দিন দুপুরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে ঘটনা ঘটেছে তা চসিকের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

অনেকে বলছেন, সিটি মেয়র প্রতিষ্ঠানটি কঠোরভাবে পরিচালনা করতে পারছেন না। যে কারণে করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এখন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। একজন প্রকৌশলীকে মারধরের ঘটনায় এটা প্রমাণ হয় যে, ঠিকাদাররা করপোরেশনের মেয়রকে ব্যক্তিত্বহীন মনে করেছে। না হয়, তারা এমন কাজ করতে সাহস পেতো না। মশার ওষুধ কেনা নিয়ে যে অনিয়ম হয়েছে তা মেয়রের অগোচরে হয়নি। জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় মেয়র বলেছেন, সার্ভার নাকি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিষয়টা দাঁড়ালো-ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘সম্প্রতি সিটি করপোরেশনে একজন প্রকৌশলীকে মারধর, মশার ওষুধ কেনা নিয়ে অনিয়ম ও জন্মনিবন্ধন সনদের সার্ভার হ্যাক করার ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি যে ক্ষুন্ন হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। এসব ঘটনায় আমার নিজেরও কষ্ট লাগে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটিতে আমি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছি। আমি বলবো, প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষায় মেয়রকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।’

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের মেয়র নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সিটি করপোরেশনের কাজের গতি মন্থর হয়ে গেছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর