রবিবার, ৫ মে, ২০২৪ | ২২ বৈশাখ, ১৪৩১ | ২৫ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

কয়লা আয়ান শর্মার ময়লা যায়নি


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১২:৫২ : পূর্বাহ্ণ
আয়ান শর্মা
Rajnitisangbad Facebook Page

অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে কনসার্ট আয়োজন করার নামে ৩ লাখ টাকা নিয়ে তিনি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ২০০৩ সালে। এক বছর পর, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে পাহাড়তলী থানার এক পুলিশ সদস্যের কাছে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন তিনি।

শুধু কি তাই? তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি, মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সখ্যসহ রয়েছে রাজ্যের অভিযোগ। সাংবাদিকতার মতো মহান পেশার নাম ভাঙিয়ে এহেন অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার কারণে ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে মুচলেকা দিতে হয়েছিল তাকে।

তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, সাংবাদিকতার মহান পেশার সঙ্গে তার কলঙ্কিত নাম কখনো জড়াবেন না। কিন্তু সেই মুচলেকায়ও কাজ হয়নি।

এখনো চলছে তার তাবৎ অপকর্ম। প্রবাদ আছে, ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’। কয়লা আয়ান শর্মারও ময়লা যায়নি। হ্যাঁ, তার নাম আয়ান শর্মা।

কয়লা আয়ান শর্মার ময়লা যায়নি

২০০৮ সালে ঢাকার একটি আদালতে মামলা করেন এক নারী। আয়ান শর্মার বিরুদ্ধে মামলায় বিয়ের জাল কাগজপত্র তৈরি করে স্ত্রী দাবি করার অভিযোগ আনা হয়। পরিস্থিতি বেগতিক টের পেয়ে ওই নারীর পরিবারের সঙ্গে ঝটপট সমঝোতা করে নেন ধূর্ত আয়ান শর্মা।

অভিযোগ উঠেছে, সাংবাদিকতাকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে অপকর্মে জড়িতদের নিয়ে তিনি বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে চাঁদাবাজি, চলে মাদক কারবারও।

গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ভয় দেখিয়ে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সমাজের গণমান্য ব্যক্তিদের চরিত্র হননেও পিছপা নয় আয়ান শর্মা গং।

তার টার্গেট আওয়ামী লীগের নেতা ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্মানজনক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের দিকে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা আয়ানের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

জানা গেছে, কথিত সাংবাদিক আয়ান শর্মা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদ এলাকায় বেণী মাধব শর্মার ছেলে। তার দাদার নাম রেবতী মোহন শীল। বর্তমানে ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ নামে একটি পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রকাশক।

পত্রিকাটি নিয়মিত ছাপা না হলেও অনলাইনে প্রতিদিনই সংবাদ প্রকাশ করছে। এসব সংবাদের অধিকাংশই বিতর্কিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

২০২২ সালে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জানিয়েছিলেন পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ হয় না, তাই কেন এটি বাতিল করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

সে সময় তিনি আরও জানান, ইতোপূর্বে প্রকাশিত পত্রিকার কপি চাওয়া হলেও দিতে পারেননি আয়ান শর্মা। পরে বিভিন্ন প্রেসে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের নাম বসিয়ে কয়েক বছরের পত্রিকা ছাপানো হয়। সে সময় একই অভিযোগে সাতটি পত্রিকার ঘোষণা বাতিল হলেও অজ্ঞাত কারণে সে যাত্রায় টিকে যায় আয়ান শর্মার চট্টগ্রাম প্রতিদিন।

দৈনিক আমাদের সময় এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।

অভিযোগ রয়েছে, অনলাইন ভার্সনে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সংগঠনের নেতা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করে আয়ান শর্মা। অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসব সংবাদ তুলে ধরা হয়। মোটা টাকা ধরিয়ে দিলে সংবাদ প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

তার কয়েকটি সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি সংবাদ প্রকাশের পর পরে আরেকটি সংবাদে তার সাফাই গাওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা অপসাংবাদিকতার নামান্তর।

জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা
বিএনপি জোট-সরকারের আমলে নিজেকে দলীয় লোক পরিচয় দিয়ে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়েছিলেন আয়ান। অবশ্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি আওয়ামী লীগের অনুসারী বলেই দাবি করেন।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনলাইন ভার্সন চালু হয়েছিল জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিয়ে। কেএন হারবার কনসোর্টিয়াম ছিল বড় অর্থের জোগানদাতা।

ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি হাসান মাহমুদ চৌধুরী। তার মালিকানাধীন কাশেম-নুর ফাউন্ডেশনের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কেএন হারবার।

জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বনে যাওয়া হাসান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ভাবশিষ্য ও ব্যবসায়িক অংশীদার।

হাসান মাহমুদের মৃত্যুর পর ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবর দেওয়ার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজন।

তারা অভিযোগ করেছিলেন, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ মুুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী হত্যায় সাবেক শিবির নেতা হাসান মাহমুদের দায় আছে।

পুলিশের কাছে চাঁদা দাবি
২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর পাহাড়তলী থানার তৎকালীন একজন এএসআইর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে হুমকি-ধমকি দেন আয়ান শর্মা।

ওই এএসআই সাংবাদিক ইউনিয়নে অভিযোগ দেন। ইউনিয়নের তৎকালীন নেতারা প্রেসক্লাবে আয়ান শর্মা ও তার আরেক সহযোগীকে হাজির করেন।

সেখানে অপরাধ শিকার করে এ ধরনের কাজে জড়াবে না বলে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। ওই ঘটনার পর একাধিক স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে তার ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ হয়।

কয়লা আয়ান শর্মার ময়লা যায়নি

ডিবির তদন্তে চাঁদাবাজ আয়ান শর্মা
প্রেসক্লাবে আয়ান শর্মার মুচলেকা নেওয়ার জেরে সাংবাদিক ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ ও কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আয়ান শর্মা।

কয়লা আয়ান শর্মার ময়লা যায়নি

২০০৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সেটি তদন্তের নির্দেশ দেন। একই বছরের ১৯ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন ডিবির তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার একেএম মোশাররফ হোসেন মিয়াজী। তদন্তে আয়ান শর্মাকে সাংবাদিক নামধারী চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

কয়লা আয়ান শর্মার ময়লা যায়নি

জানা গেছে, ২০০২ সালের দিকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সাংবাদিক নামধারী টাউট চক্র গড়ে ওঠে। এর নেতৃত্বে ছিলেন আয়ান শর্মা। ওই চক্রটি কোনো দুর্বল বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ, বিরোধ নিষ্পত্তি করে দেওয়া, পুলিশের মাধ্যমে মামলায় জড়ানোর ভয় দেখানো এবং সাধারণ ব্যবসায়ী, প্রশাসন ও নিরীহ লোকজনের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির মাধ্যমে হয়রানি, অর্থ আত্মসাৎ ও সুযোগ-সুবিধা আদায়ে লিপ্ত ছিল। কয়েক বছর ধরে একটি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে সংবাদ ছাপিয়ে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে।

আয়ান শর্মার পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছে আরও কতিপয় নামধারী সাংবাদিক, যাদের অনেকেই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, পরিবহন শ্রমিক, ঠিকাদার, অসাধু হোটেল ব্যবসায়ী, সিএমপির তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী, বিভিন্ন মামলার আসামি, বিএনপির ক্যাডার ও রেলের সম্পত্তি দখলদার।

নগরীর স্টেশন রোডে মোটেল সৈকত হোটেলে স্পা সেন্টার চালু করেছিলেন আয়ান শর্মা। অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে ২০১৮ সালে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে ১৮ নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছিল কোতোয়ালি থানা পুলিশ। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে সেখানে নিয়ে ফাঁদে ফেলার অভিযোগ আছে আয়ান শর্মার বিরুদ্ধে।

নিজের অপকর্মের যাতে প্রতিবাদ করতে না পারে সে জন্য নিজেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। ফলে প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে নিজের অবস্থান জাহির করতে চান, তেমনটাই মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে আয়ান শর্মা বলেন, আমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কোথাও কোনো থানায় বা আদালতে চাঁদাবাজি, মানুষকে হুমকি দিয়েছি এমন কোনো অভিযোগ বা মামলা নেই। আমি যদি এগুলো করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আপনার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ না দিয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ করতো। ব্যক্তিগতভাবে আপনি কী পেয়েছেন সেটা আমার দেখার বিষয় না। এগুলো সবই ভিত্তিহীন কথা। আমার ‘চট্টগ্রাম প্রতিদিন’ একটি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পত্রিকা। আমি নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করি।

অপসাংবাদিকতার দায়ে মুচলেকা দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আমি কখনো মুচলেকা দেইনি। মুচলেকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। প্রেসক্লাব কী কোনো আদালত যে, সেখানে মুচলেকা দেব। জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর