চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর জি ব্লকে হাউজিং এস্টেটের সাড়ে ৭ কাঠা আয়তনের একটি প্লটে গড়ে উঠেছে ১১ তলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন। এতে ১৩৩০ বর্গফুটের ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্লটটির মালিক হলো ১৪ জন। কিন্তু তারা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কাছে ১১ তলা ভবন নির্মাণের তথ্য গোপন করেছেন। ৮৫ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্লট মালিক ও চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা যোগসাজশে ভয়াবহ এই অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হালিশহর জি ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৪ নম্বর লেনে সড়কের পাশে এই জমির (১ নম্বর প্লট) অবস্থান। ২০১৯ সালের ১১ মার্চ প্লটটি নাশবাহ নুর নামের এক নারীকে লিজ দেয় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। পরে তিনি ২০১৯ সালের ৫ মে ১৪ জন ক্রেতার কাছে প্লটটি বিক্রি করে দেন।
১৪ জন ক্রেতা হলেন-কাউছার পারভীন খান, জাহানারা ভূঁইয়া, ফেরদৌস আরা বাবর, সহিদুজ্জামান, জেসমিন সুলতানা, নাসমিন সুলতানা, শাহীন আক্তার মিলি, মো. কামরুল হাসান শামীম, মো. মঞ্জুর হোসেন চৌধুরী, মো. গোলাম সরওয়ার, মো. জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া, মো. ছানা উল্লাহ, মোহাম্মদ আবুল খায়ের এবং জাকারিয়া মোস্তারিজ জাহান।
পরে এই ১৪ জন ক্রেতা প্লটটি তাদের নামে নামজারি করেন। এরপর তারা প্লটটিতে ভবণ নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
১৪ জন ক্রেতার মধ্যে মো. গোলাম সরওয়ার তার প্লটের ৩৮৫.৭১ বর্গফুট অংশ অপর দুই ক্রেতা সহিদুজ্জামান ও কামরুল হাসান শামীমের কাছে লিজ হস্তান্তরের জন্য সম্প্রতি হালিশহর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তার নিকট আবেদন করেন। এরপর চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সুপারিশপত্র পাঠান।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ হাওলাদার সুপারিশপত্রে প্লটটিতে ১১ তলা ভবন নির্মিত হওয়ার বিষয়টি গোপন করে তা খালি অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা এই সুপারিশপত্রের একটি কপি রাজনীতি সংবাদের হাতে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্লটটিতে ৪ বছর আগে আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত মার্চ মাসে প্লটটিতে ১১ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
গত ৩০ মার্চ হালিশহর জি ব্লকের ১ নম্বর রোডে অবস্থিত প্লটটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে একটি সাদা রঙয়ের ১১ তলা ভবন গড়ে উঠেছে। এতে ১৩৩০ বর্গফুটের ৩০টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
ভবনটির কেয়ারটেকার মো. সেলিম এই প্রতিবেদককে জানান, গত ১০ মার্চ থেকে ভবনটির ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া শুরু হয়। ৩০ মার্চ পর্যন্ত ভবনটির ৮টি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, হাউজিং এস্টেটের প্লট ও ফ্ল্যাট কেনা-বেচার ক্ষেত্রে লিজ হস্তান্তর ও নামজারি ফি প্রদান করতে হয়। লিজ হস্তান্তর ফি প্রদান করতে হয় বিক্রেতাকে আর নামজারি ফি দিতে হয় ক্রেতাকে। ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মালিককে ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ প্রতি বর্গফুট ৬৫ টাকা করে লিজ হস্তান্তর ফি প্রদান করতে হয়। সে হিসাবে ১১ তলা ভবনটির ১৩৩০ বর্গফুটের ৩০টি ফ্ল্যাটের লিজ হস্তান্তর ফি’র পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬ লাখ টাকা। ১৫০০ বর্গফুটের কম আয়তনের ফ্ল্যাটের নামজারি ফি প্রদান করতে হয় ৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে ৩০টি ফ্ল্যাটের নামজারি ফি’র পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকা। এ ছাড়া প্লটসহ ভবনের রেজিস্ট্রি ফিও প্রদান করতে হয়।
চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হালিশহর আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট ১৩৬ টাকা করে রেজিস্ট্রি ফি প্রদান করতে হয়। সে হিসাবে হালিশহর হাউজিং এস্টেটে ১১ তলা ভবনের ১৩৩০ বর্গফুটের ৩০টি ফ্ল্যাটের ৫ শতাংশ ভ্যাটসহ রেজিস্ট্রি ফি’র পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫৭ লাখ টাকা।
সে হিসাবে হালিশহরের জি ব্লকে সাড়ে ৭ কাঠার প্লটে গড়ে উঠা ১১ তলা ভবনটির লিজ হস্তান্তর ফি, নামজারি ফি ও রেজিস্ট্রি ফি’র পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৫ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা রাজনীতি সংবাদকে বলেন, বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্লটে ভবন নির্মাণের তথ্য গোপন করে থাকেন মালিকরা। ক্রেতা-বিক্রেতা ও হাউজিং এস্টেটের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। এক্ষেত্রে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ভবনটি নির্মাণের তথ্য গোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্লটটির লিজ হস্তান্তর ও নামজারির অনুমতির জন্য তিনি বিক্রেতা ও ক্রেতাদের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ হাওলাদার এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথা বলেন।
রাজনীতি সংবাদকে তিনি প্রথমে বলেন, ‘আবেদনকারী নির্মাণবিহীন প্লটের লিজ হস্তান্তর ও নামজারির অনুমতির জন্য আবেদন করেছেন। তিনি যখন আবেদন করেছেন তখন ভবনটি নির্মাণাধীন ছিল।’
ভবনটি নির্মাণাধীন থাকলে আবেদনপত্রে কেন নির্মাণবিহীন উল্লেখ করলেন? আর আবেদনের পর কেন প্লটটি পরিদর্শন করেননি?-এসব প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘আবেদনকারী ভবন নির্মাণের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। এটা আমরা জানতাম না। ইতোমধ্যে তাকে ডাকা হয়েছে। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছি, আবেদনপত্রে ভবনের কথা কেন উল্লেখ করলেন না? তিনি আবার ভূমিসহ ভবনের নামজারির জন্য আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন।’
আপনি তো ইতোমধ্যে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদনপত্রটি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটার কী হবে?-এ প্রশ্নের উত্তরে হাউজিং এস্টেটের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আবেদনের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
এই প্লটের লিজ হস্তান্তর ও নামজারি করার জন্য আপনার বিরুদ্ধে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটা কি সত্য?-এ প্রশ্নের জবাবে হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘এটা ভিত্তিহীন অভিযোগ। হয়তো আমার অফিসের কোনো কর্মকর্তা ষড়যন্ত্র করে এই অপপ্রচার করছে। আমি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি।’
এই প্লটের ১৪ জন মালিকের মধ্যে মোহাম্মদ আবুল খায়েরের সঙ্গে কথা বলেছে রাজনীতি সংবাদ।
তিনি বলেন, ‘এই প্লটের বিষয়ে হাউজিং এস্টেটের সঙ্গে ডিল করেন নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু ও আশরাফুল হক খান স্বপন। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন।’
আশরাফুল হক খান স্বপন হলেন এ প্লটের ১ নম্বর মালিক কাউছার পারভীন খানের স্বামী।
আশরাফুল হক খান স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও এ বিষয়ে আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে এই প্লটের ১৪ জন মালিকের তালিকায় আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুর নাম নেই।
এই প্লটের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা) মো. আহসান হাবিব রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘ধারণা করছি, রাজস্ব ফাঁকি দিতে প্লটটিতে ভবন নির্মাণের বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে। কাজটা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’
চট্টগ্রাম দুদকের উপ-পরিচালক নাজমুস সাদাত রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘প্লটটির দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ পেলে আমরা আমলে নেবো।’