করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরসের যতগুলো ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে তার মধ্যে এটি সবচেয় বেশি মিউটেশন ঘটা বা পরিবর্তিত সংস্করণ।
এতে এতো বেশি মিউটেশন ঘটেছে যে একজন বিজ্ঞানী একে ‘ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
আরেকজন বিজ্ঞানী বিবিসির প্রতিবেদককে বলেছেন যে, এটি তাদের দেখা করোনাভাইরাসের সবচেয়ে খারাপ রূপ।
ভাইরাসটি এখনো শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে এটি আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনার এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, ভ্যাকসিন অকার্যকর করে দেওয়ার ক্ষেত্রে এর সক্ষমতা কত বেশি এবং এর বিরুদ্ধে কী করা উচিত তা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে।
এসব প্রশ্নের বিষয়ে অনেক অনুমানই করা হচ্ছে। কিন্তু এখনো তেমন কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
ভাইরাসটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আমরা যা জানি
আলফা এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতোই গ্রীক কোড-নামের প্যাটার্ন অনুসরণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করেছে ওমিক্রন।
এটি করোনাভাইরাসের অবিশ্বাস্যরকমভাবে পরিবর্তিত একটি রূপ।
দক্ষিণ আফ্রিকার সেন্টার ফর এপিডেমিক রেসপন্স অ্যান্ড ইনোভেশনের পরিচালক অধ্যাপক তুলিও দে অলিভিয়েরা বলেছেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে বিপুল সংখ্যক মিউটেশন ঘটেছে এতে এবং এটি করোনার অন্যান্য রূপগুলো থেকে একেবারেই আলাদা। এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের অবাক করে দিয়েছে, এটি বিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি বড় লাফ দিয়েছে এবং এতে আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি মিউটেশন ঘটেছে’।
এক সংবাদ সম্মেলনে প্রফেসর ডি অলিভিয়েরা বলেন, এতে সব মিলিয়ে ৫০টিরও বেশি মিউটেশন ঘটেছে। আর শুধু এর স্পাইক প্রোটিনেই ৩০টিরও বেশি মিউটেশন হয়েছে, যা ভাইরাসটিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করেই ভাইরাসটি আমাদের শরীরের কোষে প্রবেশ করে। বেশিরভাগ ভ্যাকসিনও এই স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করেই বানানো হয়েছে।
ভাইরাসটির যে অংশ আমাদের শরীরের কোষের সঙ্গে প্রথম সংযোগ স্থাপন করে, সেই রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনে ১০টিরও বেশি মিউটেশন ঘটেছে। এর আগে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বেলায় যেখানে মাত্র দুটি মিউটেশন ঘটেছিল। কিন্তু, রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনে মাত্র দুটি মিউটেশন নিয়েই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছিল।
মিউটেশনের এই বিশাল উল্লম্ফন সম্ভবত এমন একজন রোগীর কাছ থেকে এসেছে যিনি ভাইরাসটিকে পরাজিত করতে পারেননি।
তবে মিউটেশন মানেই যে, ভয়ঙ্কর কিছু, তা ভাবা ঠিক নয়। মিউটেশনগুলো আসলে কী করছে তা জানাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ভয়ের একটা বিষয় হলো, এই ভাইরাসটি চীনের উহানে প্রথম আবির্ভূত হওয়া মূল ভাইরাস থেকে একেবারেই ভিন্ন। তার মানে, করোনার মূল স্ট্রেনগুলো ব্যবহার করে যেসব ভ্যাকসিন ডিজাইন করা হয়েছিল, সেগুলো এর বিরুদ্ধে ততটা কার্যকর নাও হতে পারে।
এর কিছু মিউটেশন এর আগে অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টেও দেখা গেছে। সেসব থেকে এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে কিছু অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়।
উদাহরণস্বরূপ N501Y মিউটেশন। এটি করোনভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সহজ করে তোলে। এর ফলে এমন কিছু ঘটে যা অ্যান্টিবডিগুলোর জন্য ভাইরাস সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে এবং ভ্যাকসিনগুলোকে কম কার্যকর করে দিতে পারে এই মিউটেশন। তবে এতে কিছু মিউটেশন রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণ নতুন।
দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড লেসেলস বলেছেন, ‘নতুন মিউটেশনগুলোর ফলে হয়তো ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা আরও অনেক বেশি বেড়ে গিয়ে থাকতে পারে, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাও হয়তো বেড়েছে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অকার্যকর দেওয়ার ক্ষমতাও বেড়ে যেতে পারে’।
তবে আগেও এমন অনেক ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে, যেগুলো কাগজে খুব ভীতিকর বলে মনে হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি।
চলতি বছরের শুরুতে বিটা ভ্যারিয়েন্টকে সবচেয় ভয়ঙ্কর মনে করা হয়েছিল। কারণ এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অকার্যকর দিতে পারতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি তেমন কিছুই করতে পারেনি। তার পরিবর্তে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত বিশ্বকে দখল করে নিয়েছিল।
ল্যাবরেটরিতে আরও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর সম্পর্কে একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যেতে পারে। তবে বাস্তব জগতে ভাইরাসটির ওপর নিরীক্ষণ থেকে আরও দ্রুত উত্তর আসবে।
ওমিক্রন ভাইরাসটি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় এখনো আসেনি। তবে ইতিমধ্যেই এর মধ্যে এমন কিছু লক্ষণ দেখা গেছে যা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার গাউতেং প্রদেশে ৭৭ জন, বৎসোয়ানায় চারজন এবং হংকংয়ে একজনের শরীরে এই ভাইরাস ধরা পড়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েল এবং বেলজিয়ামেও এই ভাইরাস ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে।
তবে, এমন ইঙ্গিতও রয়েছে যে ওমিক্রন আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সব প্রদেশেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে এ থেকেই বলা যাচ্ছে না যে, এটি ডেল্টার চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি টিকা থেকে আসা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা এড়াতে পারবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ২৪% মানুষকে সম্পূর্ণভাবে টিকা দেওয়া হয়েছে। ফলে তার চেয়ে অনেক বেশি টিকা দেওয়ার হার রয়েছে এমন দেশগুলোতে এই ভাইরাস কতটা ছড়িয়ে পড়বে তাও বুঝা যাচ্ছে না। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপুল সংখ্যক লোকের কোভিড ছিল।
তবে ভাইরাসটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা অনেক কম, কিন্তু এর বৈশিষ্ট্য দেখে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গভীরভাবে এর ওপর নজর রাখতে হবে।
কারণ, মহামারীর শিক্ষা হল সব সময় সব উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না, তার আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সূত্র: বিবিসি