রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৯ এপ্রিল, ২০২৪ ৩:০১ : অপরাহ্ণ
‘সদকাতুল ফিতর’ দুটি আরবি শব্দ। সদকা মানে দান, আর ফিতর মানে রোজার সমাপ্তি বা ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। এটিকে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাও বলা হয়ে থাকে।
একজন রোজাদার ব্যক্তির রোজা পালন করতে গিয়ে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, যার কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না, কিন্তু রোজার ত্রুটি হয়। রোজার এ ত্রুটি মার্জনার জন্যই ফিতরা আদায় করতে হয়। যেমন-একজন রোজাদার ব্যক্তি দিনের বেলায় পানাহার করেনি, যার কারণে তার রোজা নষ্ট হয়নি। কিন্তু পরনিন্দা বা গীবত করেছে, অশ্লীল কথাবার্তা বলেছে, এতে রোজা ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। এ থেকে রোজাকে পরিশুদ্ধ করার জন্যই সদাকাতুল ফিতর।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সদকাতুল ফিতর আদায় করা না-হয়, ততক্ষণ আসমান ও জমিনের মাঝখানে রোজা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে’। (কানযুল উম্মাল, হাদিস নম্বর- ২৪১২৪)।
ইসলামী শরীয়ত মতে, কোনো ব্যক্তি ফিতরা না দিলে তার কবিরা গুনাহ হবে।
কীভাবে ফিতরা আদায় করতে হবে?
অধিকাংশ আলেমের মতে, খাদ্যের বদলে খাদ্যের মূল্য দিয়ে ফিতরা আদায় করলে তা আদায় হবে না। দলিলের দিক থেকে এই মতটি অধিক শুদ্ধ। বরং ওয়াজিব হলো খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা। যেভাবে রাসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ আদায় করেছেন। উম্মতের অধিকাংশ আলেম এ মতের পক্ষ অবলম্বন করেছেন।
হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন। এর পরিমাণ হলো, এক ‘সা’ যব বা এক ‘সা’ খেজুর। ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব।’ (সহীহ বুখারি, হাদিস নম্বর-১৫১২)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, “আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর, কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। (মুয়াত্তা মালেক, পৃষ্টা-১২৪)।”
সদাকাতুল ফিতর সম্পর্কিত হাদিসগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাসূলের (সা.) যুগে এবং সাহাবাদের আমলে সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দিয়ে।
আলেমদের অনেকে বলেছেন, যে খাবার স্বাদের জন্য মানুষ মাঝেমধ্যে খেয়ে থাকে যেমন-সেমাই, নুডুলস, তেল, দুধ, চিনি দিয়ে ফিতরা দিলে হবে না। যে খাবার খেয়ে মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারবে তা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে হবে। যেমন চাইল চাউল দিয়ে ফিতরা আদায় করা যাবে।
খলিফা হযরত মুআবিয়ার (রা.) যুগে খেজুরের পরিবর্তে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের প্রচলন ছিল। এর কারণ হলো যে, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যমানের খাদ্য। কিন্তু তখন অনেক সাহাবী মুআবিয়ার (রা.) এর এই সিদ্ধান্ত মানেননি।
আবু সা‘ঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “মুআবিয়া (রা.) যখন অর্ধ ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ খেজুরের সমপরিমাণ নির্ধারণ করলেন, তখন আবু সা‘ঈদ (রা.) তা মেনে নিলেন না এবং বললেন, আমি সদকাতুল ফিতর রাসুলের (সা.) সময়ে যা দিয়ে আদায় করতাম এখনও তা দিয়ে আদায় করবো। এক ‘সা’ খেজুর অথবা এক ‘সা’ কিশমিশ অথবা এক ‘সা’ যব কিংবা এক ‘সা’ পনির।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর-৯৮৫)।
হযরত মুআবিয়ার (রা.) আমলে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। (আলইসতিযকার, হাদিস নম্বর-৫৯০, ৯/৩৫৪)
একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) কে হযরত আবু মিজলায (রহ.) বললেন-‘আল্লাহ তাআলা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম। অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্তু সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন?
উত্তরে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।’
এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবীদের অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন, তাই ইবনে ওমর (রা.) সাহাবাদের তরিকা অবলম্বন করতে সারা জীবন খেজুর দ্বারাই তা আদায় করেছেন।
‘সা’ কী?
আরবিতে ‘সা’ নির্দিষ্ট পরিমাপের একটি পাত্রকে বলা হয়, যার দ্বারা দানা জাতীয় শস্য মাপা হয়। মাঝারি দেহের অধিকারী মানুষের দুই হাতের কব্জি একত্র করে চারটি ছোট পাত্রে যে পরিমাণ খাবার উঠে তাই এক ‘সা’।
আমাদের দেশে সতর্কতামূলক এক ‘সা’ = তিন কেজি ৩০০ গ্রাম, আর আধা ‘সা’ = এক কেজি ৬৫০ গ্রাম হিসাব করা হয়।
ফিতরা কার ওপর ওয়াজিব?
ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য আছে (একদিন ও এক রাতের খাদ্যের অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ থাকলে) এরকম প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজের ও পরিবারের সমস্ত সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা প্রদান করা ফরজ। নাবালক ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে তাদের বাবাকে এই ফিতরা দিতে হয়। যার নিকট এক দুই বেলার খাবার ব্যতীত অন্য কিছু অবশিষ্ট নেই, তার ফিতরা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে?
সাধারনভাবে গরীব, দুঃস্থ, অসহায় ও অভাবগ্রস্থ ব্যক্তিকে ফিতরা প্রদান করা যাবে। তবে নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কেউ দরিদ্র থাকলে তাকে ফিতরা দেওয়া সবচেয়ে উত্তম। এমনকি ভাই-বোনের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকলে তাদেরও ফিতরা দেওয়া যাবে। কিন্তু মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের জন্য ফিতরা দেওয়া যাবে না। কারণ এটা শুধু দরিদ্রদেরই হক। উল্লেখ্য যে, মালিক ইচ্ছে করলে নিজের কাজের লোককে ফিতরা প্রদান করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে তিনি বেতন বা পারিশ্রমিক হিসেবে ফিতরা প্রদান করতে পারবে না। আর একজনের ফিতরা একজনকে দেওয়াই উত্তম। তবে একজনের ফিতরা একাধিক ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যাবে।
ফিতরা কখন আদায় করতে হবে?
ফিতরা ঈদের নামাযের আগেই বন্টন করা ওয়াজিব। ঈদের নামাযের পর পর্যন্ত দেরি করা জায়েয নয়। বরঞ্চ ঈদের এক বা দুই দিন আগে আদায় করে দিলে কোনো অসুবিধা নেই।
আলেমদের বিশুদ্ধ মতামত অনুযায়ী, ফিতরা আদায় করার সময় শুরু হয় ২৮ রমজান। কারণ রমজান মাস ২৯ দিনও হতে পারে। আবার ৩০ দিনও হতে পারে। রাসুলের (সা.) সাহাবীগণ ফিতরা ঈদের একদিন বা দুই দিন আগে আদায় করতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) মিসকিনদের জন্য খাদ্যের উৎস হিসেবে রোজা পালনকারীর উপর ফিতরা ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে ফিতরা আদায় করবে তা কবুলযোগ্য ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পর আদায় করবে সেটা সাধারণ সদকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর-১৬০৯)
আরও পড়ুন:
ফরজ গোসল না করে সাহরি খেলে কি রোজা হবে?
আজান চলাকালে সাহরি খাওয়া যাবে কি?