রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ৪:১৭ : অপরাহ্ণ
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে নৌকার প্রার্থী এম এ লতিফের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে নগর আওয়ামী লীগ। চট্টগ্রাম নগরীর ৮ ও ১০ আসনে কয়েকজন দলীয় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয়নি নগর আওয়ামী লীগ। কিন্তু চট্টগ্রাম-১১ আসনে এম এ লতিফের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন খোদ নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। শুধু আ জ ম নাছির নয়, ১১ আসনের আওতাধীন থানা-ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও সুমনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির চট্টগ্রাম-১১ আসনেও দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার বাড়ি বন্দরটিলায়। তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের গণ্ডির বাইরে এই আসনের বাকি ৯টি ওয়ার্ডে সুমন তেমন পরিচিত মুখ না হলেও তার জন্য আটঘাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এ ছাড়া দলের মনোনয়ন বঞ্চিত আরও কয়েকজন নেতাও সুমনের তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সুমনকে সমর্থন দিয়ে তারা তিনবারের এমপি লতিফকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
এর আগে ২০০৮ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে লতিফ বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু এবার দলের এক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তার সামনে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
গত ২৭ নভেম্বর বন্দর এলাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনের পক্ষে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। এতে উপস্থিত ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ওই সভায় জিয়াউল হক সুমন এম এ লতিফের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা-হয়রানিসহ বিগত ১৫ বছরের নানা খতিয়ান তুলে ধরে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে একটি চিঠি দেন।
গত ২৮ নভেম্বর নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় চিঠিটি পড়ে শোনান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। এরপর তিনি চিঠিতে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে নেতাদের মতামত জানতে চান। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজনসহ অনেক নেতা লতিফের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। এরপর সভায় এম এ লতিফের বিরুদ্ধে অনাস্থা ঘোষণা করা হয়। পরদিন নগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লতিফের মনোনয়ন পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়ে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়।
কিন্তু নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এম এ লতিফ সুমনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না। এমনকি সুমনের পাশে দাঁড়ানো নগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকেও তিনি গণ্য করছেন না।
জানতে চাইলে এম এ লতিফ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি তিনবারের নির্বাচিত এমপি। কী কারণে একজন কাউন্সিলরকে চ্যালেঞ্জ মনে করবো? তাকে তো কেউ চিনেও না। আমি তাকে কাউন্টও করি না। জামানত হারায় কিনা দেখেন।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমনকে নগর আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের সব নেতাকে মাঠে নামতে বলেন। দেখি, কার কত জোর। তাদের মনে রাখা উচিত, আমি ট্রেড বডি (পেশাজীবী সংস্থা) করা লোক। এই আসন বিএনপির ঘাঁটি ছিল। আমীর খসরুর মতো একজন বাঘা নেতাকে পরাস্ত করে এই আসনকে আমি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বানিয়েছি।’
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের সঙ্গে আপনার একসময় সুসসম্পক ছিল, কিন্তু তিনি কেন এখন আপনার বিরুদ্ধে একেবারে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন-এ প্রশ্নের জবাবে এম এ লতিফ বলেন, ‘তিনি (আ জ ম নাছির) এই আসনেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। অথচ তার মেয়র নির্বাচনের সময় আমি লাঠি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কখনো এই কাজ করিনি। বন্দরের একটা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব হয়েছে। ওর সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাই না।’
আপনার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে প্রার্থী পরিবর্তন করতে নগর আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন-জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘তারা কে? তাদেরকে এ অধিকার কে দিয়েছে? তারা তো দলের নীতিনির্ধারক না। এরকম চিঠি একটা না, ১০০টা দিলেও কোনো কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। প্রধানমন্ত্রী এক থেকে দেড় বছর যাচাই করে আমাকে চতুর্থবারের মতো মনোনয়ন দিয়েছেন। তারা নামে নগর আওয়ামী লীগ হলেও তাদের সীমানা দারুল ফজল মার্কেট থেকে থিয়েটার ইনস্টিটিউট হয়ে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার পর্যন্ত। তারা রুমে বসে সভা করে আর আমি মাঠে-ময়দানে করি। শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে রাজনীতি হয় না।’
জানতে চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগ এবং এই আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমর্থনে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। আমরা ব্যক্তির বিরুদ্ধে, নৌকার বিরুদ্ধে নয়।’
এম এ লতিফ আপনাকে অচেনা মুখ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া তিনি আপনাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না। এ নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
জবাবে জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে রাজনীতির মাঠে আছি। আমি চেনা নাকি অচেনা লোক তা জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে জানান দিবে। আর আমি দুইবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। কাজেই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবো কিনা সেটা ভোটে প্রমাণ হবে। ইনশাআল্লাহ, আমি জয়ের জন্য শতভাগ আশাবাদী।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো পরিণতি হতে পারে লতিফের!
একদিকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় এবার নির্বাচনে এম এ লতিফ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, ২০১০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো পরিণতি হতে পারে এম এ লতিফের।
রাজনৈতিক মহলের মতে, ২০১০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনবারের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনজুর আলমকে দুর্বল প্রার্থী হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু মনজুর আলমের মতো একজন কাউন্সিলরের কাছে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন। যা কেউ কল্পনাও করেনি। কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর এমন ভরাডুবি হলেও তার বিরুদ্ধে নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো এবার একই পরিণতি হতে পারে এমপি লতিফের।
২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমালোচিত হয়েছেন এম এ লতিফ।
এম এ লতিফ ছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি। ব্যবসায়ী মহলে তার পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামীবিরোধী’ হিসেবে। সেই এম এ লতিফ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে দলটির নেতাকর্মীরা বিস্মিত হন!
নগর আওয়ামী লীগের একটি অংশ এমপি লতিফকে দলের লোক মনে করেন না। কারণ দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। গত ১৫ বছরে তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা অংশ নেননি। এছাড়া তিনি এলাকায় তেমন কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করেননি বলে অভিযোগ আছে।
এ অবস্থায় এবার লতিফকে খোদ দলের নেতাকর্মীরাই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া জিয়াউল হক সুমন লতিফের জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আরও পড়ুন:
চট্টগ্রামের তিন আসনে নৌকার মাঝি পরিবর্তন
নির্বাচনের আগে নতুন সমালোচনার মুখে এমপি লতিফ
চট্টগ্রাম চেম্বারে এমপি লতিফের একি কাণ্ড!