আজ ২১ আগস্ট, দেশের ইতিহাসে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। ১৭ বছর আগে এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মানুষের আর্তনাদ আর কাতর ছোটাছুটিতে তৈরি হয় এক বিভীষিকা। গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে পড়ে ওই হামলায়।
২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয়, যা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নামে পরিচিত।
সেদিন সভায় সবশেষে বক্তব্য দিতে ওঠেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বক্তব্য শেষে যখন তিনি মঞ্চ থেকে নামছেন, তখন কয়েকজন ফটো সাংবাদিক তাকে ছবির জন্য পোজ দিতে অনুরোধ জানান।
তাদের অনুরোধেই আবার মঞ্চে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। তখনই শুরু হয় হামলা। একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে গ্রেনেড। মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ আর রক্তে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সেই সড়কটি। মানুষের কান্না আর আর্তনাদে ভারী হয়ে আসে আকাশ। পরপর ১৩টি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।
সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের জায়গা ছিল না। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন দেখে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করা হয়। তবে টার্গেট করা গুলি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ি ভেদ করতে পারেনি।
হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার তৎকালীন বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে পারলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী মারা গিয়েছিলেন।
গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন অন্তত ৪০০ জন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ১৬ জন। পরে মারা যান আরো ৮ জন।
হামলায় গুরুতর আহত হয়ে তিন দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আইভি রহমান। আহত হওয়ার পর প্রায় দেড় বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ।
আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহতদের মধ্যে ছিলেন-আইভি রহমান, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া।
গ্রেনেড হামলার পর ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে গোটা রাজধানীকে। এই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক আছড়ে পড়ে দেশ-বিদেশে।
হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় সেই রোমহর্ষক ঘটনার যাবতীয় আলামত।
পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ মদদে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিএনপির নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির নেতা হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়ে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন বিচারিক আদালত। এই রায়ের বিষয়ে হাইকোর্টে আপিল মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি:
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
এছাড়াও সকাল সাড়ে ১০ টা ১৫ মিনিটে ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদ ও নিহতদের স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন।