রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :৮ জানুয়ারি, ২০২২ ৭:১৫ : অপরাহ্ণ
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে চেনেন না এ রকম মানুষ খুব কম আছে নিশ্চয়। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির কর্ণধার। বিস্ময়কর উত্থানের গল্প আছে তার জীবনজুড়ে।
প্রায় ৫০ বছর আগে সুফি মিজানুর রহমান ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকায়। এখন তার শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪টি। যেখানে কাজ করছেন ১২ হাজার কর্মী। সুফি মিজানের হাড়খাটুনি পরিশ্রমে গড়া পিএইচপি শিল্প গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন এখন ছয় হাজার কোটি টাকা।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল ও অনুকরণীয় ব্যবসায়ী সুফি মিজানুর রহমানের হাতে গড়া পিএইচপি শিল্প গ্রুপ।
স্বাধীন বাংলাদেশ ও সুফি মিজানুর রহমানের ব্যবসার বয়স প্রায় সমান। বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রাম থেকে বিস্তৃত হয়েছে পিএইচপির বিভিন্ন ব্যবসা।
ব্যবসার শুরু যেভাবে
পিএইচপি ফ্যামিলির কর্ণধার সুফি মিজানুর রহমান ছাত্র অবস্থায় মাত্র ১০০ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন কর্মজীবন।
সময় তখন ১৯৬৪ সাল। মাসিক ১০০ টাকা বেতনে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে একটি জুট বেলি কোম্পানিতে করণিকের চাকরি করেছিলেন তিনি। বিকম পড়াকালীন সুফি মিজানুর রহমান রওনা দেন চট্টগ্রামে।
১৯৬৫ সালের ১৯ মার্চ ১৬৩ টাকা বেতনে তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (সোনালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখায় ‘জুনিয়র ক্লার্ক’ পদে যোগ দেন তিনি।
বিকম পাস করার পরই তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক ছেড়ে তৎকালীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমান পূবালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় ৮০০ টাকা বেতনে জুনিয়র অফিসার পদে যোগ দেন।
চাকরি করা অবস্থায় ১৯৬৭ সালের ৪ জুলাই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সুফি মিজানুর রহমান। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর ব্যাংকের সেই সরকারী চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। ১৯৭২ সালে প্রবেশ করেন ব্যবসায়, পুঁজি ছিল মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকা!
তার বাবার পরামর্শ ছিল-‘ব্যবসা জানলে টাকা তোমার পেছনে দৌড়াবে। ব্যবসা করলে মানুষের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে পারবে।’
সুফি মিজানুর রহমান তার সহধর্মিণী তাহমিনা রহমানের বড় ভাই ও বাল্যবন্ধু মোহাম্মদ রুকুনউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করেন।
প্রথম ব্যবসা হিসেবে বেছে নিলেন টায়ার-টিউব আমদানি। ব্রিজস্টোন টায়ার আমদানি করেছিলেন জাপান থেকে। বিনিয়োগ ছিল চার হাজার ডলার। সে সময় প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ১১ টাকা। অর্থাৎ ৪৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লাভ করেছিলেন এক লাখ টাকা।
সুফি মিজানুর রহমান বলেন, ‘এতো টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার পর স্ত্রী হতবাক হয়ে যায়। আমাকে প্রশ্ন করে, কোথায় পেলাম এতো টাকা। ঘরে টাকা রাখার জায়গা ছিল না, রেখেছিলাম মুড়ির টিনে।’
এরপর একে একে গড়ে তুললেন ঢেউটিন, ভোজ্যতেল ও সুতার কারখানা। ঢাকায় এসব কারখানা গড়ে তোলেন। ‘আর এম’ নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন। অংশীদারের নাম ও নিজের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চালু করলেন ঢেউটিন তৈরির কারখানা-সি আর কয়েল মিলস। এ সময়ে আর এম গ্রুপ ভাগ হয়ে গেলো।
পিএইচপি মানে কী?
সুফি মিজানুর রহমান তার ভাগে পাওয়া জাহাজভাঙা কারখানা, অক্সিজেন কারখানা ও রাবার বাগান নিয়ে ১৯৯৯ সালের ২২ জুলাই পিএইচপি নামে আলাদা কোম্পানি গঠন করেন।
পি-তে পিস, এইচ-তে হ্যাপিনেস, এবং পি-তে প্রসপারিটি। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়-শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুফি মিজানুর রহমানকে। তিনি যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে।
২৩ খাতে ব্যবসা পিএইচপির
ঢেউটিন, ফ্লোট গ্লাস, কৃষি, মৎস্য, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা কারখানা, টেক্সটাইল, জ্বালানি পণ্য, গাড়ি সংযোজনসহ ২৩ খাতে ব্যবসা রয়েছে পিএইচপি শিল্প গ্রুপের।
সীতাকুণ্ডে পিএইচপির পরিবেশবান্ধব শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ এখন গোটা এশিয়ার মধ্যে গ্রিন শিপইয়ার্ডের পথিকৃৎ।
গাড়ি ব্যবসাতেও সুনাম অর্জন করেছে এই শিল্প গ্রুপ। ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সেডান কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি সংযোজন করে বাজারে নিয়ে আসে পিএইচপি গ্রুপ।
ঢেউটিনশিল্পেও শীর্ষ দুই নম্বরে রয়েছে পিএইচপির নাম।
পিএইচপির হাত ধরে ২০০৫ সালে দেশে প্রথম কাচের বড় কারখানা ‘পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি’ গড়ে উঠে।
শিল্পকারখানার জন্য দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে পিএইচপি।
নৌপরিবহন খাতে বিশেষ অবদান রাখায় পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে ‘মেরিটাইম অ্যাওয়ার্ড-২০২১’ নামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে।
আরও পড়ুন: মেরিটাইম অ্যাওয়ার্ড পেলো পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ
আরও পড়ুন: দেশে তৈরি পিএইচপির নতুন মডেলের সেডান কার বাজারে, রিকন্ডিশনড গাড়ির চেয়েও দাম কম
গত ৫০ বছরে একে একে ব্যবসার পরিধি বাড়লেও কখনো ঋণখেলাপির তালিকায় ছিল না পিএইচপির কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম। ব্যাংকের টাকা সময়মতো শোধ করেছে এই শিল্প গ্রুপ।
মাত্র ১০০টাকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করা সুফি মিজানুর রহমানের এই সফলতার রহস্য কী?
২০০৩ সালে ‘বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিলেন সুফি মিজানুর রহমান। সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান সেই অ্যাওয়ার্ড প্রদানের সময় সুফি মিজানুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি নাকি ১০০ টাকা বেতনের চাকরি করতা? এতো বড় ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড নিতেছো। তোমার সাফল্যের গোপন রহস্য কী?’
এর জবাবে সুফি মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ‘Divine blessings mixed with hard work backed by good intention can make miracle.’
সুফি মিজানুর রহমান মনে করেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই।
আরও পড়ুন: পিএইচপি ফ্যামেলি দেশের সকল ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকরণীয়: নওফেল
সুফি মিজানুর রহমান স্বপ্ন দেখেন, একদিন পিএইচপি হবে বাংলার টাটা।
উল্লেখ্য, ভারতীয় কোম্পানি টাটা হলো বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় লৌহজাত সামগ্রীর শিল্প-প্রতিষ্ঠান।
সুফি মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকি আর না থাকি পিএইচপি গ্রুপ হবে বাংলার টাটা। পিএইচপিতে যারা কাজ করবেন তাদের সবার থাকবে বাড়ি-গাড়ি। ঋণ দেবো, জমি দেবো, ফ্ল্যাট বানিয়ে দেবো। আমাদের গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সুইপার পর্যন্ত সবার মুখে হাসি দেখবেন।’
৭৮ বছর বয়সী সুফি মিজানুর রহমান ২০২০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শিল্পপতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক।
বর্ষীয়ান এ ব্যবসায়ী মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, আরবিসহ ছয়টি ভাষায় কথা বলতে পারেন।
সুফি মিজানুর রহমানের সাত ছেলে ও এক মেয়ে। বিদেশে পড়াশোনা শেষে দেশে এসে সাত ছেলে বাবার কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা পিএইচপি শিল্প গ্রুপকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ‘সম্ভাবনার নতুন দুয়ার’ খুলতে পিএইচপিতে যুক্ত হলেন ২৩ বছর বয়সী মহসিন ভিক্টর