রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :৩০ অক্টোবর, ২০২১ ১০:১৫ : পূর্বাহ্ণ
ফরিদ মাহমুদ, যুবলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক। বয়স ৫২ বছর। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে অতি পরিচিত মুখ এ যুবনেতা ৩৫ বছর ধরে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই যুবলীগ নেতা। মহিউদ্দিন চৌধুরী তাকে নগর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কমিটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ফরিদ মাহমুদ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
গত ২৯ অক্টোবর ফরিদ মাহমুদ রাজনীতি সংবাদের সাথে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপকালে এ তথ্য জানান।
এই যুবলীগ নেতা জানিয়েছেন, ১৯৮৬ সালে তিনি স্কুলে পড়া অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। পরবর্তীতে লালখান বাজার ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি হন তিনি।
ফরিদ মাহমুদ জানান, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় ছাত্রলীগের মিছিল নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তখন নগরীর তিনপোল মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে তৎকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আজমের জনসভা প্রতিহত করার আন্দোলনে তখন নিউমার্কেট দোস্ত বিল্ডিং মোড়ে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি জানান, অসহযোগ আন্দোলন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেওয়ার আন্দোলন এবং ওয়ান-ইলেভেনের সময় যুব ও ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। এছাড়া নগরীতে বিএনপির দুর্গ খ্যাত ডবলমুরিং-পাহাড়তলী এলাকায় দলের আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ফরিদ মাহমুদ জানান, ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নগরীর আগ্রাবাদ, দেওয়ানহাট, অলংকার, পাহাড়তলী, জিইসি মোড় ও নিউমার্কেট এলাকায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তখন মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিতে জায়গা করে নিতে পারেননি তিনি। অথচ তার হাতে গড়া ছাত্রলীগের কর্মীরা নগরীর বিভিন্ন কলেজের বড় বড় নেতা হয়েছেন বলে জানান তিনি।
ফরিদ মাহমুদের কথায়-‘আমার হাতে গড়া ছাত্রলীগের কর্মীরা তখন নগরীর সিটি কলেজের ভিপি, জিএস, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। ওমর গনি এমইএস কলেজেরও নেতৃত্বে এসেছেন। মহানগর ছাত্রলীগেরও বড় নেতা হয়েছেন। আমার কয়েকজন কর্মী এখন নগর আওয়ামী লীগেরও দায়িত্বশীল পদে রয়েছেন।’
তখন মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিতে জায়গা না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের সময় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে যাদের নাম শুনা যাচ্ছিলো, তারা সবাই বয়সে আমার ছোট ছিলো। তখন মাঈনুল করিম, ফরিদ উদ্দিন সাজ্জাদ, মাসুদ করিম টিটু, গিয়াস উদ্দিন হিরু, ইফতেখার উদ্দিন ইফতু, দেবাশীষ পাল দেবু, হাসান মুরাদ বিপ্লব, নাজমুল হক ডিউক ও এম আর আজিমের নাম শুনা যাচ্ছিলো। তখন আমি চিন্তা করলাম, আমার আর ছাত্রলীগের রাজনীতি করাটা ঠিক হবে না। কারণ সে সময় যদি ছাত্রলীগ করতাম তাহলে মহানগর কমিটিতে তাদের সঙ্গে হয়তো যুগ্ম সম্পাদক পদে থাকতে হতো।’
ফরিদ মাহমুদ জানান, ছাত্রলীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর ১৯৯৩ সালে সৈয়্দ মাহমুদুল হকের নেতৃত্বে গঠিত নগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য পদে ঠাঁই পান। পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান পান।
চট্টগ্রাম নগর যুবলীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে স্থান পাওয়াটা কি কাঙ্খিত ছিল?
এই প্রশ্নের জবাবে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘‘এটা আমার জন্য অসম্মানজনক হয়েছে। এই কমিটিটা প্রস্তাব করেছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি আমাকে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই সাধারণ সম্পাদক হয়ে যা।’ কিন্তু আমি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। তখন তিনি আমাকে বকা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুই রাজনীতিতে শাইন করতে পারবি না। তুই নিজের কথা চিন্তা না করে অন্যদের কথা চিন্তা করস। এখন সেক্রিফাইসের রাজনীতি নাই।’’
সেই প্রস্তাব কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?
ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘তখন নগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল না। মহিউদ্দিন ভাই ও দানু ভাইয়ের দুই সদস্যের কমিটি ছিল। মহিউদ্দিন ভাইকে আমি তখন বলেছিলাম, যুবলীগের এই কমিটি হলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও নানা সমীকরণ হবে। কারণ আমাদের মধ্যেও তখন আরও দুই-তিনটা বলয় ছিল। তখন আমাদের বিরুদ্ধে সবাই অবস্থান নিবে। সংগঠনের স্বার্থেই আমি নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছি।’
নগর যুবলীগের আহ্বায়কের নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রস্তাব করেননি জানিয়ে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই তাকে বিশ্বাস করতেন না। আহ্বায়ক ছিলেন যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যানের পছন্দের প্রার্থী। মহিউদ্দিন ভাই সেটা বুঝতে পেরে আহ্বায়ক পদটা যুবলীগের চেয়ারম্যানের হাতে ছেড়ে দেন। যুবলীগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সখ্যতা ছিল।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর আরও একটি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানান তিনি।
ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘‘নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর একটি পদে তিনি আমাকে স্থান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার এই প্রস্তাবও আমি ফিরিয়ে দিই। তখনও তিনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করস, রাজনীতি করতে তোর কষ্ট হবে।’’
এই প্রস্তাবটা কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?
জবাবে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমি মনে করেছি, তখন আমার আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করার বয়স হয়নি। তাই দায়িত্ব নিতে চাইনি।’
মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেই কথাগুলো কি এখন অনুভব করেন?
উত্তরে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই অভিভাবক হিসেবে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথাগুলো বলেছিলেন। কিন্তু যারা সেক্রিফাইস করে, যারা ধৈর্য্য ধরে তারা যে রাজনীতিতে ব্যর্থ হয় সেটা হলফ করে বলা যাবে না। রাজনীতিতে নিজের স্বার্থ চিন্তা করলেই যে সব সময় লাভবান হয়, সেটা আমি মনে করি না। রাজনীতি হলো কর্মের ফল। আপনার কর্মই আপনাকে যথাযথ জায়গায় নিয়ে যাবে।’
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
এ প্রশ্নের জবাবে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘সামনে নগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। আমি নগর যুবলীগের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। ২০১৮ সালে আমি কেন্দ্রে জানিয়ে দিয়েছি, যুবলীগ আর করবো না। কিন্তু নতুন কমিটি না হওয়াতে এখনো পদ ছাড়তে পারছি না। আসলে তিন বছর আগে আমাদের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। এখন ঘানি টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই ঘানি টানাতে কার লাভ হচ্ছে, ব্যক্তিগতভাবে কেউ লাভবান হচ্ছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু এটা যত দেরি করা হবে ততো দুর্গন্ধ ছড়াবে।’
নগর যুবলীগের কোন্দল কেন নিরসন হচ্ছে না-জানতে চাইলে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের আহ্বায়ক তার ইচ্ছামতো সাংগঠনিক কাজ করেন। অনেকে সময় তিনি ছেলে মানুষির কাজ করেন। ব্যানার-পোস্টারের মধ্যে নিজের ছবি দেওয়া, হইহুল্লোড় করা ও ব্যক্তি নামে স্লোগান দেওয়া-একজন অভিজ্ঞ ও রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক মানুষের কাছ থেকে আমরা এটা আশা করি না। এসব কালচার আগে ছিল না। কিন্তু তিনি (আহ্বায়ক) এসব করছেন। যা রাজনৈতিক পরিবেশকে নষ্ট করে ফেলছে।’
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-হালিশহর) আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ফরিদ মাহমুদ। আওয়ামী লীগের অপর প্রার্থী ডা. আফছারুল আমীনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নির্বাচনী মাঠে প্রচারণাও করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আফছারুল আমীন মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
দলীয় মহল থেকে জানা গেছে, তরুণ যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদের মনোনয়ন চাওয়া নিয়ে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আফছারুল আমীন তখন দলীয় বিভিন্ন ঘরোয়া সভায় তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে ফরিদ মাহমুদ বলেন, ‘গত সংসদ নির্বাচনে আমি যখন মনোনয়ন চাই, তখন আমার বয়স ৪৯ বছর। আর এই আসনের বর্তমান মাননীয় সংসদ সদস্য যখন প্রথমবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন তখন তার বয়স ছিল ৪১ বছর। তিনি যখন মনোনয়ন চেয়েছিলেন তখন তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য প্রয়াত ইসহাক মিয়া। কারণ ইসহাক মিয়াও তখন মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কাজেই আমাদেরকে বাস্তবতা মানতে হবে। প্রবীণ নেতাদের নবীনদেরকে জায়গা করে দিতে হবে। তাছাড়া অনেকেই আছেন, রাজনীতিতে আমাদের পরে এসে সংগঠনের বড় পদবী পেয়েছেন, এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। আগামী সংসদ নির্বাচনেও আমি চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবো।’
আরও পড়ুন: আজিজের বর্ণাঢ্য মিছিল সবার নজর কাড়ে!