রথো রাফি প্রকাশের সময় :১৯ জুলাই, ২০২১ ১২:৩৯ : পূর্বাহ্ণ
হজ হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য ধর্মের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভ। সামর্থ্যবান ও সুস্থ মুসলিমের জন্য জীবনে একবার হজ করা আবশ্যক। করোনা মহামারী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আগে প্রতি বছরই অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ ধর্মভক্ত মুসল্লি পবিত্র মক্কায় হজ করতে যেতেন।
আজ থেকে তিন-চার দশক আগেও বাঙালি মুসলমানের জন্য হজ পালন করা প্রায় দুঃসাধ্য বিষয় ছিল। এই মহান তীর্থযাত্রার ভাগ্য অনেকেরই ছিল না, যদিও মুসলমান মাত্রই স্বপ্ন দেখতেন তারা একদিন জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দেবেন হজের পথে।
কাবার কালো গিলাফ আর হাজরে আসওয়াদের স্পর্শে পবিত্র করবেন নিজেদের। তবে সেকালে এ স্বপ্ন পূরণ হতো হাতে গোনা কিছু মানুষের—যাঁদের অর্থবিত্ত ছিল, শরীরে তাকত ছিল আর ছিল দৃঢ় মনোবল, কেবল তাঁরাই পৌঁছাতে পারতেন কাঙ্ক্ষিত সেই মঞ্জিলে। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন অতি অল্প। সমাজে এসব ভাগ্যবান হাজির কদর ছিল খুব। কোনো বংশে একজন হাজি থাকা মানে সেই বংশের শান-শওকত কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়া।
গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত হজের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই জটিল আর দীর্ঘ। হজের প্রস্তুতি নিতেই চলে যেত বছরের পর বছর। হজযাত্রীরা নিজেদের সব ধরনের বৈষয়িক বিষয়–আশয় থেকে মুক্ত করে তবেই বের হতেন হজের উদ্দেশে।
ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি, সহায়-সম্পত্তির ভাগবাঁটোয়ারা ও আর্থিক লেনদেনের পাট চুকিয়ে তার পরেই কেবল হজ যাত্রায় যেতেন। তখন হাজি সাহেবদের বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়া হতো বেশ ঘটা করে। আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশী—সবাই ভেজা চোখে ঘাট বা স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন।
সেসময় বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে, গরু-মহিষের গাড়িতে চেপে বা দাঁড়টানা নৌকায় করে তখনকার বোম্বে বন্দরে (এখন মুম্বাই) এসে পৌঁছাতেন হাজিরা। বোম্বাই পর্যন্ত ছিল পেশাদার পথপ্রদর্শক। তখন বোম্বেতেই অনেকের সফরের সমাপ্তি ঘটত। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কেউ আবার জাহাজ মিস করতেন। সেখানেই তাঁরা রয়ে যেতেন।
বাকিরা হজ করে ফিরে এলে তাঁদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেন। তাদের বলা হতো বোম্বাই হাজি। হজযাত্রার উদ্দেশে সে সময় বোম্বে থেকে জাহাজ প্রথমে রওনা হতো পাকিস্তানের করাচিতে। সেখান থেকে জাহাজে উঠতেন আরও হজযাত্রী। এরপর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আরব উপদ্বীপের এডেন বন্দরে ভিড়ত জাহাজ। পথে ঝড়ঝঞ্ঝার দুর্ভোগ তো ছিলই।
বাঙালি হাজিদের মধ্যে খান বাহাদুর আহছানউল্লা ১৯১২ সালে হজে গিয়েছিলেন। হজ থেকে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তিনি আমার জীবন ধারা নামক বইয়ে লিখে গেছেন। এতে পাওয়া যায় ভয়ংকর সমুদ্রযাত্রার বিবরণ। তিনি লিখেছেন, ‘আমি করাচি বন্দরে গিয়ে জাহাজে উঠি। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জাহাজের দোতলায় থাকার জায়গা দেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে প্রচুর চাল, ডাল, ঘি, চিনি ও চা ছিল। আমাকে রান্নার ভার দেওয়া হলো। আমি দুপুরে খিচুড়ি রাঁধতাম। রাতে আমার একজন সহযাত্রী ইন্সপেক্টর সাহেব রুটি তৈরি করতেন।
মঞ্জিলে মঞ্জিলে কেবল জ্বালানি কাঠ ও পানি খরিদ করা হতো। পথিমধ্যে মাছ দুষ্প্রাপ্য ছিল। তবে ছাগলের মাংস পাওয়া যেত। জাহাজ সোকোট্টার (ভারত মহাসাগরে চারটি দ্বীপের একটি মালা, ইয়েমেনের অংশ) কাছে পৌঁছালে সমুদ্রে গর্জন শুরু হয়। উত্তাল তরঙ্গে জাহাজ দুলে ওঠে। আমাদের কামরার কাচের সব বাসনপত্র ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অন্ধকারের ভেতর আমি হাঁটু গেড়ে জাহাজের শিকল ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। ডেকের যাত্রীরা বমি ও মলমূত্র ত্যাগ করে দেয়।’
বর্তমান ছবি অবশ্য ভিন্ন। এখন আর মানুষকে হজ যাত্রায় ঝুকি ও দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। আধুনিক যুগে অনেক সহজ হয়ে গেছে হজ যাত্রা। বিমানে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে একদিন কি কয়েক ঘণ্টায় মক্কা নগরে চলে যাওয়া যায়।
তবে সৌদি আরবের বাইরের কোনো নাগরিক ২০২০ সালের মতো এবারও মক্কায় হজের সুযোগ পাচ্ছেন না। এবার সৌদি আরবের নাগরিক ও সে দেশে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের মাত্র ৬০ হাজার মানুষ এ সুযোগ পাচ্ছেন। তারা সবাই এর আগে করোনার টিকা গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব রেখে তারা এবারের এই হজ পালন করবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গত বছর সীমিত সংখ্যক মানুষ হজ করেছেন। তখন অবশ্য সেখান থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ঘটনা ঘটেনি। যা মুসলিম বিশ্বের মানুষদের জন্য ছিলো বড় স্বস্তির ঘটনা। বিশ্ববাসীর জন্যও তা ছিল স্বস্তির।
হজযাত্রীদের সবচেয়ে বড় মনোযোগ থাকে মক্কার পবিত্র মসজিদের প্রতি, যেখানে রয়েছে কোরানের আয়াত লেখা কালো রেশমের গিলাফে ঢাকা আল্লার ঘর, যার নাম কাবা শরিফ।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, নবী ইব্রাহিম ও তার পুত্র ইসমায়েল আল্লাহর আদেশ পেয়ে এ গৃহ নির্মাণ করেছিলেন। এ ঘর অবশ্য বারবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ বড় সংস্কার কাজ হয়েছে ১৯৯৬ সালে। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এ পবিত্র ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় ও সেজদা করে থাকেন।
প্রতি বছর লাখ লাখ হজযাত্রীর জায়গার ব্যবস্থা করতে পবিত্র মসজিদুল হারামের জায়গা গত কয়েক দশকে উল্লখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরব সরকার জানায়, বিগত অর্ধ শতাব্দিতে ৯ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি হজযাত্রী মক্কার মাটিতে এসে পবিত্র হজ পালন করেছেন। একই বছরে সৌদি সরকার বছরে ৩০ লাখ হজযাত্রীর জন্য মক্কাশরীফে পবিত্র মসজিদুল হারামে জায়গা সংকুলানের জন্য এর সংস্কার পরিকল্পনাও ঘোষণা করে।
গোগল আর্থ উপগ্রহ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পবিত্র মক্কার বেশ কিছু ছবি তোলে। এসব ছবি থেকে সহজেই বোঝা যায়, কত দ্রুত এ পবিত্র শহর ক্রমাগত বেড়েছে।
হজের পক্রিয়া সম্পন্ন হতে পাঁচদিন লাগে। এ সময়ে মিনা, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জামারাত এবং পবিত্র মসজিদুল হারামসহ মক্কা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রমণ করেন ও বিভন্ন ধর্মীয় আচার পালন করেন হজযাত্রীরা।