যিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সামরিক জান্তার সঙ্গে আপস না করে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন গৃহবন্দি জীবন; শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত সেই নেত্রী ক্ষমতার অংশীদার হয়ে নিজেই সামরিক জান্তার পৃষ্ঠপোষকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। বলছি মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি’র কথা।
২০১৬ সালের শুরুর দিকে তার দল এনএলডি ক্ষমতায় বসলে শুরু হয় সু চি’র সমালোচিত হওয়ার অধ্যায়। তিনি রাখাইনে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার নিন্দা করতে কেবল অসমর্থই হননি, উল্টো সাংবাদিক এবং অ্যাকটিভিস্টদের কারাগারে পাঠানো এবং সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি নত থেকে বারবার সমালোচিত হয়েছেন।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী ধর্ষণ ও গণহত্যা চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হলেও পুরো সময়টাতেই সু চি ছিলেন নির্বিকার। তখন বিশ্ব নেতারা নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে এ সহিংস অভিযান থেকে রক্ষায় অং সান সু চি’র প্রতি বারবার আহ্বান জানালেও সু চি রক্ষার পরিবর্তে, সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে বিভেদে অংশ নিয়েছিলেন।
সেই অং সান সু চি’র নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে ক্ষমতা নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট ইউনি মিন্টসহ সু চি’র দল এনএলডির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রায় সব পরিষদ সদস্যকে বন্দি করা হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, সু চি নগ্নভাবে যে সেনাবাহিনীর স্বার্থরক্ষা করলেন এতকাল তারাই কেন তাকে সরিয়ে ক্ষমতা নিল? এর কারণ হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর চাওয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোটের বাইরে রাখা হয়েছিল সু চি’র প্রেসক্রিপশন মেনে।
তদুপরি, জাতীয় ও রাজ্য পর্যায়ে যেখানে সু চি’র দল এনএলডির প্রভাব কম সেখানে ভোটের ব্যবস্থা করা হয়নি। এসবের পাশাপাশি নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকেও নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। এসবের ইকুয়েশনে সু চি’র নেতৃত্বাধীন দল এনএলডি গত নির্বাচনের চেয়েও এবার বেশি জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতাসীন হতে চলেছিল।
মিয়ানমারজুড়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোতে যেখানে ভোট হয় ১ হাজার ১৭১টি আসনে সেখানে এবার ভোট হয়েছিল ১ হাজার ১১৭ আসনে। তাতে সু চি’র দল একাই পেয়েছে ৯২০ আসন, যা গতবারের চেয়েও ৬৬টি বেশি।
অন্যদিকে সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির আসন সংখ্যা গতবারের চাইতেও কমে যায়। তারা মাত্র ৭১টি আসন পায়, যা গতবারের চেয়েও ৪৬টি কম। ফলে ভোটের পর থেকে সেনাবাহিনী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতারণার অভিযোগে ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নতুন করে নির্বাচন আয়োজনের দাবি তোলে।
তাছাড়া ভোটের পর সেনাবাহিনী সু চি’র সঙ্গে দর-কষাকষি করছিল সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য। কেননা, এমন একটি শঙ্কাও ছিল যে, জেনারেল হ্লাইং অবসরে গেলে তিনি ও অন্যান্য জেনারেলদের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায়ে সু চি সরকার আর আগের মতো সুরক্ষা নাও দিতে পারেন।
২০১৪ সালে সংশোধিত ডিফেন্স সার্ভিসেস অ্যাক্ট অনুযায়ী, বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় আগামী জুলাই মাসেই অবসরে যাওয়ার কথা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের। এর আগেই সেনাবাহিনী জেনারেল হ্লাইংকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল৷ তবে ভূমিধস বিজয় পাওয়ায় সু চি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি এই আপস প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে মিয়ানমারের সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। এগুলো নিয়েও সু চি সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছিল। সব দ্বন্দ্বের যোগফলের বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে এই অভ্যুত্থান।
তবে এই অভ্যুত্থানের পেছনে আঞ্চলিক মদদও একটা বড় ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতীয়মান হয়। পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় নিলে এটা পরিষ্কার হয় যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের বৃহৎ দুই প্রতিবেশী চীন এবং ভারতের নীরব সম্মতিতেই ক্ষমতার দখল নিতে এগিয়ে গেছে। কারণ, গত এক সপ্তাহ জুড়ে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার দখল নেওয়ার কানাঘোঁষার পরিপ্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা দেশ একত্রে একটি বিবৃতি দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলা’র আহ্বান জানালেও ভারত ও চীন ওই বিবৃতিতে সই করা থেকে বিরত ছিল।
প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে সেনাবাহিনীর কাছে সু চি গ্রেফতার হলেও তার সারাজীবনের অর্জিত ইমেজকেও তিনি নষ্ট করেছেন সেনাবাহিনীর প্রতি অন্ধ পক্ষপাতিত্বের কারণেই।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে তখন অনেকেই ভেবেছিলো দোষ সামরিক বাহিনীর, সু চি’র নয়। তবে আসল সত্যিটা ছিল, রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো জঘন্য অপকর্মে সু চিও সমর্থন দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালে হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের শুনানিতে সু চি’র অবস্থান পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায়। তখন রাখাইন প্রদেশে ঘটে যাওয়া প্রকৃত ঘটনা স্বীকার করার জন্য আটজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তাকে আহ্বান জানালেও, সু চি সেনাবাহিনীর প্রতি নগ্নভাবে মিথ্যাচার করেন।
মূলত গত কয়েক বছরে সু চি’র ঘনিষ্ঠরাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার অবস্থানে বারবার অবাক হচ্ছিলেন। তারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, তিনি ধর্ষণ, হত্যা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা রুখতে কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি কোনো নিন্দা জ্ঞাপন করেননি কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি।
তদুপরি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার বারবার অবগত করলেও এ নিয়ে টালবাহানা করে গেছে সু চি সরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সু চি কোনো পদক্ষেপই নেননি।
সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সু চি’র একক সংগ্রাম এবং মিয়ানমারকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে ভূমিকা প্রশংসিত হলেও রোহিঙ্গা গণহত্যায় নির্লিপ্ত থাকা এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে বারবার প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ার কারণে গত বছরগুলোতে ইতিহাসের আরেক ‘খলনায়কে’ পরিণত হয়েছিলেন অং সান সু চি।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির মোহে পতিত হয়ে ধর্ষণ, গণহত্যা দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো জঘন্য অপকর্মে সায় থাকার কারণে আন্তর্জাতিক বিশ্বেও তার জনপ্রিয়তা ও অবস্থান ধূলিসাৎ হতে থাকে। এ কারণেই বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি ও পদক প্রত্যাহার করে নেয়। তিনি পরিণত হতে থাকেন নিন্দা ও ধিক্কারের পাত্রে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতের জেরে পুনরায় গ্রেফতার হলেন তিনি। কিন্তু এবারে আর তার প্রতি কোনো সহমর্মিতা প্রকাশ করতে পারছি না। নীতি এবং আদর্শকে বিসর্জন দেওয়ার কারণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক সময়ের মহান নেত্রী অং সান সু চি আজ রূপান্তরিত হয়েছেন নিন্দা আর ধিক্কারের পাত্রে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
তথ্যসূত্র: যুগান্তর