মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪ | ২৩ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৪ রবিউস সানি, ১৪৪৬

মূলপাতা মতামত

মৃত্যুবার্ষিকী: সমাজ বিপ্লবের মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রো


এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া প্রকাশের সময় :২৫ নভেম্বর, ২০২০ ২:৩৯ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

পুরো নাম ফিদেল কাস্ত্রো বা ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। যিনি ফিদেল কাস্ত্রো বা শুধুই কাস্ত্রো নামে সমগ্র পরিচিত। একজন কিউবান রাজনৈতিক নেতা ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী। কিউবা বিপ্লবের প্রধান নেতা ফিদেল ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এরপর ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ তাঁর স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিউবার মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ১৯৬১ সালে কিউবা কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু প্রধান হিসেবে ছিলেন। এর আগে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০০৮ সালে তিনি তাঁর দায়িত্ব ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে অর্পণ করেছিলেন।

হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় ফিদেলের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এরপর কিউবার রাজনীতিতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা নিবন্ধ লিখে তিনি যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। অবশেষে তিনি ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ করেন, এবং তারপর কারারুদ্ধ হন ও পরে ছাড়া পান। এরপর তিনি বাতিস্তার সরকার উৎখাতের জন্য সংগঠিত হওয়ার জন্য মেক্সিকো যান। ফিরে এসে ১৯৫৬’র ডিসেম্বরে সরকার উৎখাতে নামেন।

পরবর্তীকালে কাস্ত্রো কিউবান বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন যা যুক্তরাষ্ট্রের মদদে চলা বাতিস্তার স্বৈরশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর কিছুদিন পরই কাস্ত্রো কিউবার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৬৫ সালে তিনি কিউবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান হন এবং কিউবাকে একদলীয় সমজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপ দেন। ১৯৭৬ সালে তিনি রাষ্ট্র ও মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি কিউবার সর্বোচ্চ সামরিক পদে ঈড়সধহফধহঃব বহ ঔবভব (“ঈড়সসধহফবৎ রহ ঈযরবভ”) আসীন হন।

১৯৫৫ সালের জুন মাসে রাউল কাস্ত্রোর সাথে নিকো লোপেজের মাধ্যমে চে গুয়েভারের পরিচয় হয় এবং পরে তার মাধ্যমে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন চে। কাস্ত্রোর সাথে চে’র প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। সেই সময় চে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসি তৎপরতার আশু সমাপ্তি প্রয়োজন। তারপর চে ফিদেল কাস্ত্রোর ২৬ জুলাই আন্দোলন দলের সদস্য হন।

বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালান। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রন্ত হন। তার ৮২ জন সহযোদ্ধা মারা যান অথবা কারাবন্দী হয়, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়। চে গেভারা তার বইয়ে লিখেনথ সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখামুখি সংঘর্ষের সময়, যখন তিনি তার চিকিৎসা সামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিনত করে।

সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। সেখানে তারা ২৬ জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেন। সিয়েরা থেকে দল উঠেয়ে দেবার সময় কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাতকার নিউয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা হয়। যার আগে ১৯৫৭ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর মানুষ জানত না তিনি বেঁচে আছেন কি না! সেই নিবন্ধে কাস্ত্রো ও বিপ্লবীদের কাল্পনিক ছবি ছিল।

ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন চে। যুদ্ধ চলাকালীন চে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখণ্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রো গেভারাকে গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেকানোর জন্য চুল্লি প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরির দায়িত্ব দেন। তাছাড়াও একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষনের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচার করতে উৎসাহিত করেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তিন বছর পর চে গেভারাকে ’’কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’’’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

বিশ্বে বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ছোট একটি দ্বীপদেশে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং অর্ধশতাব্দীব্যাপী সেই দেশের সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরিণত বয়সে, নব্বই বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু সারা কিউবার জনগণ কাঁদছে। সন্দেহ নেই যে তিনি ছিলেন তাঁর দেশের জনগণের অতি প্রিয় নেতা, তাদের একান্তই আপনজন। কিন্তু শুধু কিউবা নয়, এই নেতার পরিচিতি ও প্রভাব ছিল বিশ্বময়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এক বিশাল দেশ, যা পরবর্তী সময়ে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। তাই রুশ বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত বিশ্ব ইতিহাসকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। মানবমুক্তির নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল। জনসংখ্যার দিক দিয়ে সর্ববৃহৎ দেশ চীনের বিপ্লব পৃথিবীর ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছিল, শোষিত মানুষের অনুকূলে ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিকূলে। ভিয়েতনাম ছোট দেশ হলেও সুদীর্ঘকালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বহুদিন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ ‘ভিয়েতনাম সিনড্রোমে’ ভুগেছিল।

ফিদেল পৃথিবীর জনগণকে আকৃষ্ট করেছেন নানা ভাবেই। তাকে প্রচন্ড ভয় পেত মার্কিন প্রশাসন। আর সেই ভয়ে তাকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করেছিল সিআইএ। ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা ও ক্ষমতাচ্যুতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার কমতি ছিলোনা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বরাবরই অভিযুক্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য। উল্লেখ্য, ৯০ বছরের জীবনে ফিদেল কাস্ত্রোকে ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:
১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আফ্রো-এশীয়-আমেরিকান গণসংহতি সম্মেলনে অংশ নিতে হাভানা গিয়েছিলেন ৬ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে। তখন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কাস্ত্রোর কথা হয়। মওলানা ভাসানী তার সঙ্গে কথা বলে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। এবং পূর্ব বাংলায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হবে সেই প্রত্যয় তার দৃঢ় হয়েছিল। কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ১৯৬৫ সালে ইউনিসেফের এক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে কিউবা সফরে যান। সেখানে তিনি মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে করমর্দন করে রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, সে কথা তিনি তার বন্ধুদের গর্ব করে বলতেন। মওলানা ভাসানী ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

সাম্যবাদের স্বপ্নদ্রষ্টা ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন বাংলাদেশেরও অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’য় ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, “আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়াস। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইস দ্য হিমালয়াস। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দি এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়াস।” বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়— “আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কাস্ত্রো ছিলেন বাংলার মানুষের পক্ষে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তিনি তার সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। পাট কিনতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগালের মধ্যে থেকেও তিনি মার্কিনিদের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করেছেন।

এমন সাহসী ও মেধাবী নেতা ইতিহাসে বিরল। ফিদেল কাস্ত্রো আজ নেই এটা সত্য, তবে রয়ে গেছে তাঁর কাজ ও আদর্শ। যা শুধু কিউবার জনগণকেই নয়, দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা জোগাবে যুগ যুগ ধরে। ২৫ নভেম্বর বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রোর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে তার অমর স্মৃতির প্রতি গভীরতম শ্রদ্ধা।

লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর