আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রকাশের সময় :১৯ নভেম্বর, ২০২০ ৭:১৭ : অপরাহ্ণ
ইউনাইটেড নেশন্স অর্গানাইজেশন কার্যক্ষেত্রে অবশ্যই ইউনাইটেড স্টেটস অর্গানাইজেশন। বাংলায় আমরা লিখি ‘জাতিসংঘ’। কলকাতার লেখকদের দেখি ‘রাষ্ট্রসংঘ’ লিখতে।
পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোকে ‘শক্তিমান রাষ্ট্র ও দুর্বল রাষ্ট্র’—এভাবে ভাগ করা উচিত। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর বোঝা উচিত, দুর্বলতার কারণেই তাদের দারিদ্র্য। তাদের বুঝতে হবে, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে হলে শক্তি অর্জন করতে হবে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো আন্তরিকভাবে সততার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিমান হতে পারে। রাষ্ট্রশক্তির অবলম্বন ছাড়া জনজীবন সমৃদ্ধ হতে কিংবা সমৃদ্ধ থাকতে পারে না।
জনজীবনে সবচেয়ে বেশি কল্যাণ সাধিত হতে পারে রাষ্ট্রের দ্বারাই। রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা দরকার।
আধুনিক রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদভিত্তিক। কোনো রাষ্ট্রে জাতীয়তাবাদই জনগণের ঐক্যের অবলম্বন। জাতীয়তাবাদ না থাকলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনগণ অনৈক্যের মধ্যে পড়ে যায়। তাতে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনগণের ঐক্যের বোধই হলো জাতীয়তাবোধ। জাতীয়তাবোধকে অবলম্বন করে রাষ্ট্র গঠনের উপলব্ধির মধ্যেই হলো জাতীয়তাবাদ।
জাতীয়তাবাদী প্রচেষ্টার কিংবা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গর্বিত হয় জাতিরাষ্ট্র। কোনো রাষ্ট্রের ভূ-ভাগের মধ্যে এবং জনগণের মধ্যে থাকে নানা বৈচিত্র্য। ঐক্যের নীতি অবলম্বন করে বৈচিত্র্যের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে হয়। ভৌগোলিক কিংবা জনগোষ্ঠীগত বিভিন্নতার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দুর্বল জনগোষ্ঠীগুলোর ন্যায়সংগত স্বার্থকে যথোচিত স্বীকৃতি দিয়ে, ন্যায়সংগত স্বার্থকে নিশ্চিত করে সমস্যার সমাধান করতে হয়।
বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও রয়েছে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। তাদের মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের সামান্য বেশি। এই জনগোষ্ঠীগুলোর ন্যায় স্বার্থ নিশ্চিত করা সরকারের কর্তব্য। এ ব্যাপারে সরকার উদাসীন থাকলে রাষ্ট্রের জন্য তার ফল অবশ্যই খারাপ হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে।
আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মীমাংসা করা সম্ভব। বাংলাদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৫টি ভাষা আছে। তা ছাড়া আছে বাংলা ভাষা। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কোনোটার ভাষাকে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করার উপায় আছে? বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।
উন্নতি করতে হলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে রাষ্ট্রভাষা শিখতে হবে। তাদের উন্নতির জন্যই এটা করতে হবে। তাদের ভাষার চর্চা তাদের মধ্যে থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের রাষ্ট্রভাষা অবলম্বন করতে হবে। রাষ্ট্রভাষার উন্নতির সঙ্গে তাদের উন্নতি অবিচ্ছেদ্যরূপে সম্পর্কিত। তারা যদি অন্তর্মুখী হয়ে সব বিষয়ে নিজেদেরকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখে, তাহলে তাদের উন্নতি হবে কিভাবে? তাদের শিশুরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের পারিবারিক ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষাও শিখে। বাস্তবে তারা দ্বিভাষিক।
এনজিও মহল থেকে যেসব কথা এ প্রসঙ্গে বলা হয়, তাতে তাদের চিরকাল ‘আদিবাসী’ করে রাখার মনোভাবই লক্ষ করা যায়। তাদের জাতির ও রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম থেকেই নিজেদের উন্নতির উপায় করতে হবে। পৃথিবীর সর্বত্র আদিবাসীদের মানবজাতির মূলধারায় আসার সুযোগ করে দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তাদের চিরকাল আদিবাসীরূপে রাখতে চায়। তাদের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাম্রাজ্যবাদীরা চায় না।
দেশ ও রাষ্ট্র এক নয়। পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি ইত্যাদি দুর্লঙ্ঘ্য কিছু দ্বারা পরিবেষ্টিত বিশাল ভূ-ভাগই একেকটি দেশ। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। দেশকে অবলম্বন করেই রাষ্ট্র গঠিত হয়। এক দেশে এক রাষ্ট্রই ভালো। কিন্তু সর্বত্র তা হয়নি—ব্যতিক্রম আছে। এক দেশে একাধিক রাষ্ট্র আছে, আর এক রাষ্ট্রের সীমানা একাধিক দেশেও বিস্তৃত হয়েছে।
সব দেশের এবং সব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এক রকম নয়। রাষ্ট্রের অস্তিত্বে থাকে জনগণের ভেতরকার ঐক্য ও বিরোধ। প্রতিটি রাষ্ট্রের জনগণেরই অন্যতম বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বৈচিত্র্য ও ঐক্য দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বহুত্ববাদের কথা বলে জাতির ভেতর অনৈক্য সৃষ্টি করলে জাতি টেকে না। তাতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের শর্তও নষ্ট হয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদীরা গুরুত্ব দেয় বহুত্ববাদে। বহুত্বমূলক ঐক্য কিংবা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বাঞ্ছনীয়।
শিল্পবিপ্লবের ধারায় মোটরগাড়ি, রেলওয়ে, স্টিমার ও প্রিন্টিং প্রেসের প্রসার ঘটলে যাতায়াত যোগাযোগ ও ভাবের আদান-প্রদান সহজ হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ক্ষুদ্র গণ্ডি অতিক্রম করে দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। তাতে প্রতিটি দেশের জনগণ আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার বেড়া অতিক্রম করে ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তাদের মধ্যে দৈশিক ঐক্যবোধ দেখা দেয়।
ক্রমে প্রতিটি দেশে জনগণের এই ঐক্যবোধ এমন একপর্যায়ে উত্তীর্ণ হয় যে তারা ধারণা করে, তাদের দেশে তারা যদি নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে তাদের জীবন পূর্ণতা অর্জনের ও উৎকর্ষ লাভের পরম সুযোগ পাবে। জনগণের এই দৈশিক ঐক্যবোধকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় জাতীয়তাবোধ। জাতীয়তাবোধসম্পন্ন জনসমাজকেই বলা হয় জাতি। জাতীয়তাবোধ যখন রাষ্ট্র গঠনের আদর্শে রূপ নেয়, তখন তাকে বলা হয় জাতীয়তাবাদ। গোটা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। পররাষ্ট্র দখল জাতীয়তাবাদীদের কাজ নয়।
জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যদি গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র যুক্ত হয়, তাহলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতির দিকে যায়। নিরেট জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতির দিকে যায় না। নিরেট জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বেশি দূর এগোতে পারে না। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সফল হলেও প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য হয় জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা—গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র। অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃরাষ্ট্রিক ঘাত-প্রতিঘাতের ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গতিশীল থাকে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জনগোষ্ঠীই ভাষাগত বিভিন্নতা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বিভেদ দেখা দেয়। বৈচিত্র্যের যথোচিত স্বীকৃতি দিয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য—এই নীতি অবলম্বন করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের সমস্যার সমাধান করতে হয়।
বাংলাদেশে দেখতে পাই, সব স্তরের শিক্ষিত লোকই জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং লেখেন। তাঁরা জাতীয়তাবাদকে উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ, সম্প্রসারণবাদ ইত্যাদির সঙ্গে একাকার করে দেখেন। জাতীয়তাবাদ কথাটি সামনে এলেই তাঁরা বিরক্ত হন। তাঁদের অনেকের মতে, জাতীয়তাবাদ একটি বুর্জোয়া ব্যাপার, জাতীয়তাবাদ নিয়ে শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তদের কোনো কল্যাণ নেই। তাঁরা শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলেন। আন্তর্জাতিকতাবাদকে তাঁরা জাতীয়তাবাদের বিরোধী মনে করেন।
আসলে জাতীয়তাবাদ আছে বলেই জাতীয়তাবাদের সম্পূরক হিসেবে আন্তর্জাতিকতাবাদ দরকার। জাতিরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সব কাজই জাতীয় সরকার করবে। বাস্তবে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ ও যুদ্ধ দেখা দেয়। এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য দরকার জাতীয়তাবাদের সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। যেমন—জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ।
জাতিসংঘ জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র, জাতীয় ভাষা, জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিরাষ্ট্র কোনোটারই বিরোধ নয়। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এগুলো যাতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকতে পারে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সবাই উন্নতি করতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়েই জাতিসংঘ গঠিত হয়েছিল। বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রমে জাতিসংঘ ঘোষিত নীতি থেকে সরে যায়। তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদের জায়গা দখল করে নেয় সাম্রাজ্যবাদ।
সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, সম্প্রসারণবাদ, উপনিবেশবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকৃত বিকাশ। হিটলার, মুসোলিনি, মালাবার, ফ্রাঙ্কো—তাঁরা কেউই জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন ফ্যাসিবাদী। বাংলাদেশে এসব নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনাই নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ আছে, কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তা নেই।
রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্গত অবস্থায় আছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি-মারামারি আছে; কিন্তু কোনো সুষ্ঠু রাজনীতিচিন্তা নেই। এ দেশের মানুষ এখন রাজনীতিকে অত্যন্ত খারাপ কাজ বলে মনে করে এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়।
বাংলাদেশকে জনগণের স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে হবে। তার জন্য জাতীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদ দরকার। শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ দরকার।
জাতীয়তাবাদের শত্রু হলো স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ। এসবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের ভূমিকা দরকার। আর সব কিছুর মর্মে দরকার জাতীয়তাবোধ এবং জাতিরাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব বোধ। জাতিসংঘকে গড়ে তুলতে হবে বিশ্ব সরকাররূপে।
উদার গণতন্ত্র নয়; দরকার প্রগতিশীল সর্বজনীন গণতন্ত্র। প্রগতিশীল সর্বজনীন গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও অভিজ্ঞতাকে সমন্বিত করে নিতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রধর্মকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ থেকে বাদ দিতে হবে। প্রগতিশীল সর্বজনীন গণতন্ত্রের ধারণাকে বিকশিত করে জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। সংবিধানে আরো নানা পরিবর্তন দরকার।
রাজনীতিকে যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা দরকার। সততার চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো কর্মনীতি নেই। রাজনীতির উন্নতির জন্য দরকার উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এখন নেই।
রাজনীতিকে উন্নত করে তুলতে হবে—এই হোক আজ বাংলাদেশের সব স্তরের জনগণের একান্ত কামনা।
লেখক : প্রগতিশীল চিন্তাবিদ
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: কালের কণ্ঠ