বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬

মূলপাতা মতামত

যুক্তরাষ্ট্রেও ভোট চুরি হয়?




প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর ২০২০, ৫:২৩ অপরাহ্ণ

রেজানুর রহমান

বড়বাড়ির ব্যাপার-স্যাপারও বড়। ছোট ঘটনাও অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। আর বড় ঘটনা হলে তো কথাই নেই। শুধু বড়বাড়িই নয়, সারা গ্রামে হইচই পড়ে যায়। তবে এটাই স্বাভাবিক। বড়বাড়ির সব খবরই তো আগ্রহের বিষয়। কাজেই খবর ছোট কী বড়, সেটা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো বড়বাড়ি। বড়বাড়ি কোনও দোষ করে না। দোষ করলেও সেটাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। দোষারোপও করে না। কেন করবে? বড়বাড়ির বড় দায়িত্ব সেখানে ভুল-ত্রুটিই হতেই পারে। কিন্তু এই ভুলটা যদি পাশেই ছোটবাড়ির কেউ করে, তাহলেই বাধে বিপত্তি। বড়বাড়ির চোখ রাঙানি তো আছেই। আরও আছে নানান ধরনের হুঁশিয়ারি। গণতন্ত্র গেলো গেলো বলে নানান ধরনের হুঁশিয়ারি শুরু হয়। ভাবটা এমন, ছোটদের ভুল করতে নেই। তবে বড়রা ভুল করতেই পারে। মানি না মানবো না, এ কথাও বলতে পারে। বড়দের ব্যাপার-স্যাপারই যেন আলাদা!

যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর একটি দেশ। সে কারণে এই দেশের ভালো-মন্দ মুহূর্তের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আর যদি সেটা হয় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচন, তাহলে তো গোটা পৃথিবীর মানুষ সতর্ক হয়ে ওঠে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেরও ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে দেয়। আর তাই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে বিপুল আগ্রহ দেখা দেয় গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে। যথারীতি এবারও তাই হয়েছে। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গোটা পৃথিবীর প্রচার মাধ্যম জুড়ে একটাই খবর—যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন।

নির্বাচনে ভোট গ্রহণ পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মানি না মানবো না’ ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলেন। নির্বাচনে ভোট চুরির অভিযোগও তুলেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইতিহাসে এ ধরনের অভিযোগ এর আগে তেমন শোনা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাবেন–এটাই রীতি। কিন্তু জো বাইডেন জয়ী হবার পর তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প রীতি অনুযায়ী বিজয়ী প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাননি। বরং তিনি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

এখানেই বেধেছে বিপত্তি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠবে এ যেন অবিশ্বাস্য ঘটনা। অন্য দেশের জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই সোচ্চার থাকে। অথচ সেই দেশেই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক দেশ হয়তো সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তবে আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছে এবার কি যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলার যৌক্তিক সাহস পাবে?

ওই যে বললাম বড়বাড়ির ব্যাপার স্যাপারও বড়। বড়বাড়ি, বড়লোকদের ভুল ধরতে নেই। সে রকমই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ভুল ধরারও কোনও মানে হয় না। তবে একথা সত্য, যুক্তরাষ্ট্রে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রেরই জয় হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার গুরুত্ব পেয়েছে। পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয় মেনে না নিলেও গণতন্ত্রই জয়ী হয়েছে। বিজয়ী প্রার্থী জো বাইডেন একটি চমৎকার কথা বলেছেন, ‘আমি এখন আর লাল নীলকে দেখবো না। দেখবো যুক্তরাষ্ট্রকে।’ এর চেয়ে মহৎ উচ্চারণ আর কী হতে পারে?

এ কথা সত্য, পরাজিত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন আইনের পথেই তাকে হাঁটতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে আইনের প্রতি সবারই রয়েছে সম্মান শ্রদ্ধা। এক সময় হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে সকল অস্থিরতা সংকটও কেটে যাবে। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার গৌরব অক্ষুণ্ন রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের বোধকরি একটু সচেতন হওয়া উচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে নিয়ে ট্রল করছেন। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে অনেকে কৌতুকপূর্ণ ছবি আঁকছেন। পরনে লুঙ্গি পরিয়ে কৌতুক করতেও দেখলাম একজনকে।

একজনকে দেখলাম ট্রাম্পের ছবির পাশে লিখেছেন, ‘আমি তো ভালা না, ভালা নিয়াই থাইকো…’ এই যে আমরা নানান ধরনের কৌতুক করছি, ট্রল করছি…এটা কি আদৌ শোভন হচ্ছে? আমাদের বোধকরি একটু সংযত হওয়া দরকার। কার সম্পর্কে কী বলছি, কী মন্তব্য করছি, বলার আগে অথবা করার আগে ভাবা জরুরি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমাদের প্রচার মাধ্যমে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চাওয়া-পাওয়ার ফিরিস্তি নিয়ে নানান মন্তব্য প্রকাশ হতে শুরু করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, আশা করি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসন আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। আমেরিকান চেম্বার অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেছেন, উন্নয়ন হবে ব্যবসায়িক সম্পর্কের।

একথা সত্য, চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রেও যোগ্যতা লাগে। কারও কাছে চাইবার আগে আমাদের উচিত নিজেদেরকে যোগ্য করে তোলা। এক্ষেত্রে অহেতুক কারও সমালোচনা না করে যার যার অবস্থান থেকে আমাদের উচিত স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করা। উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় দেশ এগোলেই শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুর অভাব হবে না। কাজেই অন্যের সমালোচনা না করে আসুন নিজেকে যোগ্যতম অবস্থানে দাঁড় করাই।

আবারও বলি, অন্যের সমালোচনা করার আগে নিজের সম্পর্কে সমালোচনাটা আগে জরুরি। কী করছি, কেন করছি? এটা কি আমি বা আমরা নিশ্চিত জানি? নাকি বলার সুযোগ আছে বলেই বলছি? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আজকাল তো সবাই বক্তা। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে হেয় করা অথবা তার চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে গালাগাল করা এখন যেন এক ধরনের ‘ফ্যাশনে’ পরিণত হয়েছে। এই প্রবণতা মারাত্মক ক্ষতিকর একথা জেনেও অনেকে এই ‘মহান’ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। তাদের উদ্দেশে বিনীত পরার্মশ, এমন কোনও কথামালায় নিজেকে জড়াবেন না যাতে করে শুধুমাত্র আপনার কারনেই প্রিয় মাতৃভূমি বিব্রত হয়।

লেখাটি শেষ করি। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী জো বাইডেনের বিজয় ভাষণের একটি লাইন আবারও উল্লেখ করতে চাই। ‘বিভেদ নয় ঐক্য চাই। কোন রাজ্য নীল কোন রাজ্য লাল, তা আমি দেখি না। আমি দেখি যুক্তরাষ্ট্রকে’। এটাই হলো দেশাত্মবোধ। দেশকে ভালোবেসে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এর চেয়ে মহৎ উচ্চারণ আর কী হতে পারে?

আমরা কি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে এই মহৎ উচ্চারণকে গুরুত্ব দিতে পারি না? ডান বুঝি না, বাম বুঝি না। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম বুঝি না, বুঝি শুধু বাংলাদেশ। আমার, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকেই বুঝি…দেশকে ভালোবেসে ভালো থাকুন সকলে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

তথ্যসূত্র:বাংলা ট্রিবিউন

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর