রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক
প্রকাশের সময় : ৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭:০৭ অপরাহ্ণ
সিরিয়ায় ৬১ বছর ধরে চলা আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির শাসনের নাটকীয় অবসান ঘটেছে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা মাত্র ১২ দিনে পতন ঘটিয়েছে আসাদ পরিবারের ৫৪ বছরের এবং বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের। তাদের দ্রুতগতির অভিযান আসাদ, তার মিত্র এবং বাকি বিশ্বকে হতবাক করেছে।
আজ রোববার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ হারানোর মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে।
মূলত ২৭ নভেম্বর দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোতে বিদ্রোহীদের আক্রমণ শুরু হয়। এরপর ১ ডিসেম্বর আলেপ্পোর কুর্দি যোদ্ধাদের দখলে থাকা কিছু সংখ্যাগরিষ্ঠ কুর্দি এলাকা বাদে বাকি অংশ নিজেদের দখলে নেয় বিদ্রোহীরা। এরপরে ৫ ডিসেম্বর সিরিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর হামা দখল করে ৭ ডিসেম্বর আসাদ সরকার নিয়ন্ত্রিত রাজধানী দামেস্ক ঘেরাও এর অভিযান শুরু করে বিদ্রোহীরা।
আজ ভোরে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসের নিয়ন্ত্রণ এবং দামেস্কে প্রবেশের ঘোষণা দেয় বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে রাজধানী থেকে ব্যক্তিগত বিমানে করে পালিয়ে যান আসাদ। তবে কোথায় গিয়েছেন তা এখনো অজানা।
মাত্র ১২ দিনের অভিযানেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসন শেষ হলো। ইতোমধ্যে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কের পূর্ণ দখল নিয়েছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর স্বৈরশাসক আসাদমুক্ত হল দেশটি। দেশের অভ্যন্তরের সংঘাত নিরসনে দীর্ঘ সময় আসাদের পাশে ছিলো রাশিয়া এবং ইরানের মতো শক্তিশালী মিত্ররা। তবে শেষ মুহূর্তে মিত্রদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি।
বাশার আল-আসাদের পালানোর খবরে দামেস্কের রাস্তার রাস্তায় উদযাপন দেখা যায়। বিদ্রোহীরা বলছে, সিরিয়ায় আসাদ শাসনের অবসান দেশটির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সিরিয়ায় ১৯৬৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। ১৯৭০ সালে হাফেজ আল-আসাদ অভ্যন্তরীণ দলীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে তার ছেলে বাশার আল-আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং শাসন চালিয়ে যান।
যুদ্ধ ও পতনের প্রেক্ষাপট
বাশার আল-আসাদ ২০০০ সাল থেকে সিরিয়ার ক্ষমতায় রয়েছেন। এর আগে তার বাবা হাফেজ আল-আসাদ ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন। তবে ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই সময় বিক্ষোভকারীদের দমনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করেন তিনি। এরপর বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেন। এতে করে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং দেশটিতে মানবিক সংকট চরমে পৌঁছে। যদিও ২০১৫ সালে বাশার আল আসাদকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে রাশিয়া। সে বছর সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল লক্ষ্য করে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় তারা। এরপর বিদ্রোহীরা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে শাসকগোষ্ঠী আলেপ্পো, ইদলিব এবং হামাসহ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারায়। ২৭ নভেম্বর থেকে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং বিরোধীরা দ্রুত রাজধানীর দিকে অগ্রসর হয়।
গতকাল শনিবার দামেস্কের দক্ষিণ অংশে প্রবেশ করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। আজ রোববার সকালে সরকারি বাহিনী রাজধানীর ওপর থেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারায়।
কোথায় পালিয়েছেন বাশার আল আসাদ?
বিদ্রোহীদের প্রতিরোধের মুখে রাজধানী দামেস্ক ছেড়ে পালিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সিরিয়ার জ্যেষ্ঠ দুজন সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আসাদ একটি উড়োজাহাজে চড়ে গেছেন। তবে তার গন্তব্য জানা যায়নি।
এদিকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার বিষয় নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম জানায়, দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর বিমানটি রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
দুটি সিরিয়ান সূত্র জানিয়েছে, বিমানটি আকস্মিক মোড় নেয়, যার কারণ অজানা। যা এই দুর্ঘটনার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি কে ওই বিমানে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর বার্তা
বাশার আল-আসাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজি আল-জালালি সামাজিক মাধ্যমকে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা জনগণের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত এবং সব ধরনের সহায়তা দেবো।
এ সময় তিনি জনগণকে সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সিরিয়ার সম্পদ সব সিরিয়দের। এ দেশ আবারও স্বাভাবিক হবে এবং বিশ্বের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলবে’।
গত ২৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে আলেপ্পো, ইদলিব এবং হামাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলো বিরোধী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। গত শুক্রবার দারা প্রদেশও দখলে নেয় বিদ্রোহীরা।
শনিবার সুইদা ও কুনেইত্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও বিদ্রোহীদের দখলে আসে।
আর সকালে দামেস্কের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সেনারা সরে যায়।
বাথ শাসনের পতনের প্রভাব
আসাদ সরকারের এই পতনের মাধ্যমে শুধু ৬১ বছরের বাথ শাসনেরই পতন নয়, আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের একচ্ছত্র ক্ষমতারও অবসান ঘটল। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে এখন পুরো সিরিয়া এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি
আরও পড়ুন: সিরিয়ায় আসাদের পতনের মাস্টারমাইন্ড কে এই আল-জোলানি?