শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ | ১৪ আষাঢ়, ১৪৩১ | ২১ জিলহজ, ১৪৪৫

মূলপাতা দেশজুড়ে

সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ খাদ্য সংকট


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৮ জুন, ২০২৪ ৭:১৭ : অপরাহ্ণ
খাদ্য সংকটে দিন কাটছে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের। ছবি: সংগৃহীত
Rajnitisangbad Facebook Page

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দ্বীপ থেকে উপজেলা টেকনাফের নৌ যোগাযোগ ২০ দিন ধরে বন্ধ থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাতের কারণে নাফ নদী ব্যবহার করা যাচ্ছে না। নৌপথ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো তেমন পথ নাই। আরেকটি বিকল্প সেন্টমার্টিন থেকে জাহাজযোগে কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ। এটা সময়সাপেক্ষ এবং শুধু জাহাজ দিয়েই সম্ভব।

তবে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেছেন, এখন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা চাইলে নাফ নদী ব্যবহার করে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করতে পারেন।

আর আইএসপিআর আর জানিয়েছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের একাধিক জাহাজ মিয়ানমারের জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় থেকে নিয়মিত টহল দিচ্ছে।

সেন্টমার্টিন টেকনাফের একটি ইউনিয়ন। জনসংখ্যা ১০ হাজারের মতো।

সেন্টমার্টিনের ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান জানান, এই ২০ দিনে মাত্র একবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সেন্টমার্টিনে খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। আর সেটা ছিলো জেলে এবং যারা সরকারের ভিজিএফ কার্ডধারী। ফলে এখন খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনের কিছু মানুষ জেলে আর অধিকাংশই কৃষক। চাহিদার ২০ ভাগ খাদ্যও এখানে উৎপাদন হয় না। জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ আছে। বন্ধ আছে পর্যটন। ফলে আয়ের উৎস যেমন বন্ধ তেমনি বাইরে থেকে খাদ্য আনারও কোনো সুযোগ নাই। আর তিন-চার দিনের মধ্যে যদি খাদ্য সরবরাহ করা না হয় তাহলে অনেককেই অনাহারে থাকতে হবে।

একই কথা বলেন সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের এখানে ঈদ নাই। আতঙ্কে আর খাদ্য সংকটে আমাদের দিন কাটছে। দ্বীপের মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই। নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় তারা কাজের জন্য কোথাও যেতে পারছেন না৷ দোকানে যে চাল, তেল, ডাল পাওয় যাচ্ছে তার দাম অনেক। শাকসবজি শেষ হয়ে গেছে। বোট চলাচল শুরু না হলে সামনের দিনে আমরা কী খাবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের খোঁজ কেউ নিচ্ছে না। না জনপ্রতিনিধি, না প্রশাসন। একবার মাত্র খাদ্য পাঠিয়ে তারা চুপচাপ আছেন। ওই খাদ্যে কয়জনের হয়!

টেকনাফ স্পিডবোট মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলম বলেন, গত দুইদিন ধরে আমরা গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি না৷ তবে দূরে মিয়ানমারের সমুদ্র সীমায় তাদের যুদ্ধ জাহাজ এখনো অবস্থান করছে। আর বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের দুইটি জাহাজ টহল দিচ্ছে। আমরা খুব কষ্টে আছি। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্বীপের বাইরে নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। একটির নামমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে সেখানে সাধারণ রোগেরও চিকিৎসা সম্ভব নয়। আর খাদ্য সামগ্রী দ্রুত ফুরিয়ে আনছে। আমাদের এখন দরকার নাফ নদীর চ্যানেলটি নিরাপদ ও উন্মুক্ত করে দেয়া। তা না হলে আসলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েই থাকব। কারণ সমুদ্র পথে জাহাজ দিয়ে কক্সবাজারে আমাদের যোগাযোগ সম্ভব নয়। যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বোট চালক, মাঝিমল্লারাও বেকার হয়ে পড়েছেন।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক জানান, তাদের খাদ্যের প্রয়োজন হলে আমরা আরো খাদ্য পাঠাবো। আর এখন তারা চাইলে নাফ নদী ব্যবহার করতে পারেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওখানে যা হচ্ছে তা তো মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেন্টমার্টিনের লোকজন আবহাওয়ার কারণে এখন নৌপথ ব্যবহার করছেন না। তারা তো এই পরিস্থিতির মধ্যেই আসা-যাওয়া করেন। তারপরও আমরা আরো একটু পরীক্ষা করে তাদের এই নৌপথ ব্যবহারের জন্য বলবো। তবে এখন ব্যবহারে কোনো বাধা নেই।

এদিকে আইএসপিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, বর্তমানে মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একাধিক যুদ্ধজাহাজ অপারেশন পরিচালনা করছে। মিয়ানমার নৌবাহিনী সেন্টমার্টিনের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় অবস্থানের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে অবহিত করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১২ জুন প্রতিবাদ জানায়।সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের একাধিক জাহাজ মিয়ানমারের জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় থেকে নিয়মিত টহল দিচ্ছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির এই সংঘর্ষের কারণে নাফ নদী এবং নদী সংলগ্ন মোহনা এলাকায় বাংলাদেশি বোটের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমার নৌবাহিনী সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় এবং নাফ নদীর মিয়ানমার সীমানায় অবস্থান করে মিয়ানমারের দিকে আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। একই সঙ্গে আরাকান আর্মিও মিয়ানমার নৌবাহিনীর জাহাজ ও বোট লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড এবং তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় চলমান রয়েছে।

সেন্টমার্টিনের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার উইং-এর মহাপরিচালক মিয়া মোহাম্মদ মইনুল কবির বলেন, আইএসপিআর বিবৃতিতে যা বলেছে এর বাইরে আমাদের কাছে আর কোনো বাড়তি তথ্য নেই।

এদিকে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, নৌবাহিনী এখন যে টহল দিচ্ছে এটা আরো আগে করলে ভালো হতো। তাহলে সেন্টমার্টিনের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হতো না। এখন দরকার দ্রুত নাফ নদীর চ্যানেলটি নিরাপদ করে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ চালু করা। তবে নতুন আরেকটি সমস্যার কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আরকান আর্মি কিন্তু রোহিঙ্গা বিরোধী। তারা বুধিডং ছেড়ে রোহিঙ্গাদের চলে যেতে বলেছে। এর আগে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখন ওই রোহিঙ্গারা কোন দিকে মুভ করে তা বাংলাদেশের নজরে রাখা উচিত। তা নাহলে নতুন একটি সংকট হতে পারে।

মেজর জেনারেল (অব.) হীদুল হক বলেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা না জেনে শুনে কথা বলছেন। সেন্টমার্টিন কোনো পক্ষেরই টার্গেট না। আমরা মাঝখানে পড়ে গেছি। তবে আমাদের শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে।

একই ধরনের কথা বলেন মিয়ানমারের সিটুয়েতে বাংলাদেশের সাবেক মিশন প্রধান মেজর (অব.) মো. এমদাদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, আরাকান আর্মির নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে তাদের হয়ে যুদ্ধ করলে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এতে আমাদের এখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তিনিও মনে করেন সেন্টমার্টিন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বা আরকান আর্মির টার্গেট নয়। তাই এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্বহীন কথা বলা উচিত নয়। তবে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই শক্ত অবস্থানের জানান দিতে হবে।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে

আরও পড়ুন: সেন্টমার্টিন সীমান্তে গোলাগুলি বাংলাদেশের জন্য হুমকি: মির্জা ফখরুল

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর