শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৭ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

খেলার মাঠে ‘টাকার মেলা’

বাণিজ্য মেলার নামে চট্টগ্রাম চেম্বারের কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’


রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :১৪ মার্চ, ২০২৪ ৬:৪০ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

আইন অনুযায়ী খেলার মাঠ খেলা ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার বা ভাড়া দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর ধরে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড খেলার মাঠে আয়োজন করা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা’। প্রতি বছরের মতো চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে এবার এই মেলার ৩১তম আসর বসেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। মাসব্যাপী এই মেলার আসর ১৫ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মেলার সময় আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আয়োজকরা।

চার লাখ বর্গফুটের এই পলোগ্রাউন্ড মাঠের মালিক রেলওয়ে। সাড়ে ৪৩ লাখ টাকার বিনিময়ে রেল কর্তৃপক্ষ মাঠটি মাসব্যাপী মেলা আয়োজনের জন্য চট্টগ্রাম চেম্বারকে ভাড়া দিয়েছে। মাসব্যাপী এই মেলার প্রস্তুতি এবং আয়োজন শেষে স্থাপনা সরাতে লাগে অন্তত দুই থেকে তিন মাস। এতে মাঠের পুরো অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে টানা তিন মাস খেলাধূলা বন্ধ থাকে।

খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, খেলার মাঠ অন্য কোনোভাবে ব্যবহার বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। এই আইন লঙ্ঘনে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় সাজার বিধান আছে।

এ ছাড়া ২০১৪ সালের ৬ মে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সব খেলার মাঠ ও পার্ক রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

আইন অমান্য করে কেন পলোগ্রাউন্ড খেলার মাঠ মেলার জন্য ভাড়া দেওয়া হলো?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। গত ৩১ বছর ধরে এই মাঠে মেলা হয়ে আসছে। চট্টগ্রামে বাণিজ্য মেলার জন্য পলোগ্রাউন্ড ছাড়া আর কোনো বড় মাঠ নেই। আর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী এই মাঠে এসে মেলার উদ্বোধন করেছেন। কাজেই আমরা সবকিছু জেনে বুঝে এই মাঠ চট্টগ্রাম চেম্বারকে মেলার জন্য ভাড়া দিয়েছি।’

বছরের পর বছর ধরে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়ামের পাশের মাঠে বইমেলা এবং আউটার স্টেডিয়ামে বিজয় মেলাসহ আরও বিভিন্ন মেলার আসর বসতো। তবে ২০২৩ সাল থেকে সেখানে সব ধরনের মেলার আয়োজন বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন।

কিন্তু চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড খেলার মাঠে বাণিজ্য মেলা বন্ধ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আমি জেলা প্রশাসনের জন্য পলোগ্রাউন্ড মাঠ বরাদ্দ চেয়েছিলাম। যাতে সেখানে খেলাধূলার আয়োজন করা যায়। কিন্তু তারা মাঠটা বরাদ্দ দেয়নি। অথচ মেলার জন্য তারা এই মাঠ ভাড়া দিয়েছে। পলোগ্রাউন্ড মাঠে বাণিজ্য মেলা বন্ধ করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন ও সুশীল সমাজকে এ বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে সামনে পলোগ্রাউন্ড মাঠে আর কোনো মেলার আয়োজন করা না হয়।’

বাণিজ্য মেলা বন্ধের দাবিতে গত ২৯ জানুয়ারি পলোগ্রাউন্ড মাঠের সামনে মানববন্ধনও করে নগরীর বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন।

মানববন্ধনে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাহী সদস্য নাসির মিয়া প্রশ্ন রাখেন, ‘খেলার মাঠে মেলা হবে না-এমন সিদ্ধান্ত যদি বিজয় মেলা কর্তৃপক্ষ মানতে পারে, তাহলে চট্টগ্রাম চেম্বার কেন পারবে না? ব্যবসায়ী সংগঠন বলেই কি তারা আইনের ঊর্ধ্বে?’

শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স ১৯৯৩ সাল থেকে পলোগ্রাউন্ডের খেলার মাঠে মেলার আয়োজন করে আসছে। অথচ ঢাকা চেম্বার অব কমার্স রাজধানীতে কোনো মেলার আয়োজন করে না। ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।

অথচ পলোগ্রাউন্ড খেলার মাঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার নামে কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’ করছে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স। চট্টগ্রাম চেম্বারের অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রতি বছর বাণিজ্য মেলা থেকে প্রতিষ্ঠানটি আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা আয় করে।

কিন্তু বাণিজ্য মেলা শুধু নামেই ‘আন্তর্জাতিক’। গত ৩১ বছরেও এ মেলা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিতে পারেনি। নামকাওয়াস্তে বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত বেশিরভাগ প্যাভিলিয়নে দেশি ব্যবসায়ীরা স্টল বসিয়ে ব্যবসা করছেন।

বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে। বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের গুণগত মান যাচাই ও দরদাম করেন এবং পছন্দের পণ্যের ক্রয়াদেশ দেন। পণ্য প্রদর্শনী ৩ থেকে ৫ দিনের বেশি হয় না। সেখানে কোনো পণ্য বিক্রি হয় না, শুধু পণ্যের ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলায় পণ্য বেচাকেনা হয়।

চট্টগ্রামের খ্যাতনামা শিল্পপতি ও পেডরোলো এনকে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশে আমি বিভিন্ন মেলায় গিয়েছি। সেসব মেলায় পণ্য প্রদর্শন করা হয়, বিক্রি হয় না, ক্রয়াদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম ও ঢাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার নামে বাণিজ্য হয়। মেলার আগে আন্তর্জাতিক শব্দটি লাগানো হয়েছে কেবল মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য। এটা ধোকাবাজি।’

গত ৩ মার্চ বিকেলে পলোগ্রাউন্ড মাঠে বাণিজ্য মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, দেশের নানা স্থানে মাজারের ওরস উপলক্ষে যে ধরনের মেলা বসে, যেন তেমনই মেলা বসেছে। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, সেসব পণ্যে ভরে গেছে মেলা। বিভিন্ন স্টলের বিক্রয়কর্মীরা ফুটপাতের হকারদের মতো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে হাঁকডাক দিয়ে পণ্যের প্রচার করছেন। ‘দেইখা লন বাইছা লন, একদাম একশ’–এভাবে ছন্দময় সুরে পণ্যের বিকিকিনি চলছে।

কেউ ছোট ছোট স্পিকারে, আবার কেউ খালি মুখেই পণ্যের গুণকীর্তন ও দাম বলতে দেখা গেছে। আবার কোথাও একটা পণ্যের সঙ্গে একটা পণ্য ফ্রি দেওয়া হচ্ছে।

মেলার ফরেন প্যাভিলিয়ন ও ফরেন জোনে ঢুকে দেখা যায়, সেখানে বোরকা, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, জুয়েলারি, জুতা, ফুলের দোকান, কার্পেট, হাঁড়ি-পাতিল, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কসমেটিকস, আচারসহ নানা পণ্যের স্টল রয়েছে। আছে ম্যাজিক দেখা ও শেখার স্টলও। ফরেন প্যাভিলিয়নে আছে ছোট ছোট ৪২টি স্টল। আর মাঠের অপর প্রান্তে ফরেন জোনে আছে ৫০টি স্টল। এর মধ্যে কেবল ফরেন প্যাভিলিয়নে কাশ্মীরের একটি ও ফরেন জোনে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তিনটি স্টল রয়েছে। বাকি সব স্টল দেশি ব্যবসায়ীদের।

বাণিজ্য মেলার নামে চট্টগ্রাম চেম্বারের কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’

ফরেন জোনে জুতা বিক্রি করা ভারতের পাঞ্জাব থেকে আসা মো. শোয়েব নামের এক ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এই জোনে ভারতের কেবল তিনটি স্টল রয়েছে। বাকি সব স্টল ঢাকার ব্যবসায়ীদের। কিন্তু তারা কেউ পাকিস্তান, কেউ ইরান, কেউ থাইল্যান্ডের পণ্য বলে বিক্রি করছেন।’

ফরেন প্যাভিলিয়নের ভেতরে সালোয়ার-কামিজ স্টলের বিক্রেতা ইসহাক মিয়া বলেন, ‘আমাদের স্টলের সব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা। তাই বিদেশি প্যাভিলিয়নে আমরা স্টল নিয়েছি।’

সরেজমিন বাণিজ্য মেলা ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের মূল প্রবেশমুখের সামনে ইট দিয়ে প্রায় স্থায়ী অবকাঠামোর মতো স্থাপনা বানিয়ে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো মাঠ ইট বিছিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। মাঠের ভেতরে চার শতাধিক স্টল বানানো হয়েছে।

মেলার মূল ফটকের বাইরেও রয়েছে ৭১টি স্টল। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এসব স্টলের ব্যবসায়ীদের কারও কাছ থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা, আবারও কারও কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয়।

বাণিজ্য মেলার নামে চট্টগ্রাম চেম্বারের কোটি টাকার ‘বাণিজ্য’

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ওমর হাজ্জাজের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে বাণিজ্য মেলার চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক আকতার হোসাইন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমরা মূলত দেশীয় পণ্যকে প্রদর্শন করার জন্য প্রতি বছর এই মেলার আয়োজন করি। মেলায় কোনো বিদেশি ক্রেতা এসব পণ্য দেখলে আমদানির জন্য অর্ডার করতে পারে। আবার দেশের রপ্তানিকারকরাও বিদেশে এসব পণ্য রপ্তানি করতে পারে।’

কিন্তু মেলায় তো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতেগুনা কয়েকটি। বিদেশি ক্রেতারও দেখা মেলে না। তাহলে এটা আন্তর্জাতিক মেলা হয় কীভাবে?

এই প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মেলার চেয়ারম্যান বলেন, ‘চট্টগ্রামের মতো ঢাকায়ও তো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হয়। প্রধানমন্ত্রী ওই মেলার উদ্বোধন করেন। সেখানেও তো বেশিরভাগ দেশীয় পণ্য প্রদর্শন করা হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি সালামত আলী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চেম্বার বছরের পর বছর ধরে বাণিজ্য মেলার নামে বাণিজ্য করছে। সেখানে আন্তর্জাতিক মেলার নামে দোকানদারি হয়। এটা আসলে টাকার মেলা। এই বাণিজ্য মেলায় বেশিরভাগ ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা হয়। ক্রেতাদের ঠকানো হয়। আমরা আগামী বছর এই বাণিজ্য মেলা বন্ধ করার উদ্যোগ নেবো।’

গত ২১ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া মাসব্যাপী ঢাকা বাণিজ্য মেলায় ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করার অপরাধে ৩৬ প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে বাণিজ্য মেলায় ভোক্তা অধিকার এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘বাণিজ্য মেলার কোনো দর্শনার্থী কোনো পণ্যের বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। এরপরও আমরা বাণিজ্য মেলার পণ্যের গুনগত মানের বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

আরও পড়ুন: মাসে কোটি টাকা আয় করেও ট্যাক্স দেয় না চট্টগ্রাম চেম্বার

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর