রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :১৭ জুলাই, ২০২৩ ১:১৫ : অপরাহ্ণ
পুরো বছরজুড়ে দেশের আনাচে-কানাচে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন হয়ে থাকে, যা বেশ পরিচিত একটি চিত্র। কিন্তু প্রতি বছর পবিত্র মহরম মাসে চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসা মোড়ে জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে আড়ম্বরপূর্ণ আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের যে আসর বসে, তা যেন এক ভিন্ন চিত্র! ইসলামী সংস্কৃতিতে যা ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে।
বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত থাকে মাহফিলের মঞ্চ। আর সেই মঞ্চে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের মিলনমেলা ঘটে। মঞ্চের সামনে উপস্থিত থাকেন হাজারো মুসল্লি। কোরআন তেলাওয়াত, হামদ-নাত ও বরেণ্য আলেমদের দরদমাখা হৃদয়স্পর্শী বয়ানে মুখরিত হয়ে ওঠে এই মাহফিল।
এ বছর জমিয়তুল ফালায় বসছে শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের ৩৮তম আসর। আগামী ২০ জুলাই থেকে এই মাহফিল শুরু হচ্ছে। চলবে ২৯ জুলাই পর্যন্ত। প্রতিদিন বাদে আছর থেকে শুরু হবে কার্যক্রম। ৬ষ্ঠ দিন থেকে মাহফিলে মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা থাকবে।
সাধারণত চট্টগ্রামের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে যেসব ওয়াজ মাহফিল হয়, তা গভীর রাত পর্যন্ত চলে। কিন্তু শাহাদাতে কারবালা মাহফিল রাত ১০টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
এই মাহফিলের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন চট্টগ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ছুটে আসেন এই মাহফিলে।
শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। ‘খতিবে বাঙ্গাল’ খ্যাত জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের সাবেক খতিব ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মরহুম আল্লামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী মহররম মাসে আহলে বায়তে রাসূল (দ.) স্মরণে এই মাহফিলের সূচনা করেন।
তার মৃত্যুর পর এই মাহফিলের ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন দেশের খ্যাতনামা শিল্পগ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান ও সমাজসেবায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিল্পপতি সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তবে জাঁকজমকপূর্ণ এই মাহফিল সফলভাবে আয়োজনের পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখে ‘আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদ’। সংগঠনটির কর্মককর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এই মাহফিল প্রতি বছর কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা ছাড়া সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়।
শাহাদাতে কারবালা মাহফিল এখন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। কালের পরিক্রমায় এই মাহফিলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
ইরাক, মালয়েশিয়া, কানাডা, লেবানন, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও পীর মাশায়েখরা এতে অংশ নেন। ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্ব বরেণ্য আলেমরা এই মাহফিলে অংশ নিয়ে এর শোভা-সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছেন।
মাহফিলে আমন্ত্রিত আলেমরা সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর আলোকে বয়ান করে থাকেন। তারা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন না। আয়োজক কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রিত আলেমদের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেন।
এ ছাড়া ১০ দিনব্যাপী এই মাহফিলে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সরকারি-বেসকারি পদস্থ ব্যক্তিরা অতিথি ও আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
জানা গেছে, বিশ্বের আর কোনো মুসলিম দেশে মহররম মাসে আহলে বায়তে রাসূল (দ.) স্মরণে এরকম বর্ণাঢ্য আয়োজনে শাহাদাতে কারবালা মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় না।
সুফি মিজানুর রহমান কেন এই মাহফিলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন?
১০ মহররম দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মন্তুদ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ইরাকের কারবালা ময়দানে। নবী পরিবার তথা আহলে বায়তে রাসূলের (দ.) নিষ্পাপ পূতপবিত্র সদস্যগণ ৬১ হিজরিতে কারবালা ময়দানে দ্বীন ও ইসলামের জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আহলে বাইতে রাসূলের (দ.) সেই আত্মত্যাগের ঘটনা মুসলমানদের মাঝে সতেজ রাখতে সুফি মিজানুর রহমান শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও অনন্য অবয়ব প্রাপ্তির নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছেন তিনি। বিদেশি অতিথি ও আলোচকদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া ও সম্মানী বাবদ কোটি টাকা ব্যয় করে দ্বীন-মাজহাব-মিল্লাতের জন্য নিজেকে উৎসর্গীত করেছেন অতিশয় ধর্মপরায়ন এই শিল্পপতি।
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আল্লামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরীর সুদূরপ্রসারী চিন্তা চেতনার ফসল আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল। আহলে বাইতে রাসূলের (দ.) প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়ে দ্বীন ও সত্যের প্রতি সবাইকে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত রাখতে প্রতি বছর এই মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আহলে বাইতে রাসূলের আত্মত্যাগের ঘটনা মুসলমানদের মাঝে সতেজ রাখা ঈমানি দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে শাহাদাতে কারবালা মাহফিলের প্রধান সমন্বয়ক ও পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক আলী হোসেন সোহাগ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এবার ৩৮ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই মাহফিল। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। আহলে বায়তের শানে ১ থেকে ১০ মহরম পর্যন্ত আয়োজিত এই মাহফিলে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদেরকে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’