রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২০ জুন, ২০২৩ ১১:২৬ : পূর্বাহ্ণ
চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুসহ ৬ আসামির বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির মামলাটি আপোষ করতে বাদী বন্ধন নাথের উপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
‘আসামি পক্ষের হুমকির ভয়ে’ বাদী বন্ধন নাথ মামলাটি মীমাংসা করতে কানাডা থেকে তিনদিন আগে গোপনে দেশে ছুটে এসেছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, আগামীকাল বুধবার চট্টগ্রাম ৭ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার বাদী বন্ধন নাথের সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য থাকলেও সাক্ষী দিবেন না বন্ধন নাথ। তিনি ‘আসামি পক্ষের হুমকির ভয়ে’ চাঁদাবাজির ঘটনাটি সামাজিকভাবে মীমাংসা হয়ে গেছে মর্মে আদালতে একটি আপোষনামা দিবেন।
সূত্রটি জানিয়েছে, চাঁদাবাজি মামলাটি দায়ের করে বন্ধন নাথ বিদেশে পাড়ি জমালেও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় তার মা ও ভাইসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বসবাস করেন। বন্ধন নাথকে কব্জায় আনতে আসামি পক্ষ থেকে তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একটি পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা একজন প্রভাবশালী নেতা বন্ধন নাথকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে আপোষ করতে চাপ প্রয়োগ করেন। এসব হুমকিতে কাবু হয়ে পরিবারের সদস্যদের জীবন রক্ষায় মামলাটি মীমাংসা করার সিদ্ধান্ত নেন বন্ধন নাথ।
এ বিষয়ে জানতে বন্ধন নাথের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল রাজনীতি সংবাদের কাছে মামলাটি মীমাংসার প্রক্রিয়া চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদেও আছেন।
অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি এতোদিন ধরে এই মামলার আসামি পক্ষের হয়ে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলাম। এখন মামলাটি মীমাংসা করতে আমি ওকালতি করছি। আর চাঁদাবাজি মামলা তো মীমাংসা করা যায়। আমি যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোটা আমার কর্তব্য।’
আসামি পক্ষ বাদীকে চাপ প্রয়োগ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানা নেই।’
এ বিষয়ে জানতে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে দেবাশীষ নাথ দেবুর বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির বিষয়ে গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ। কিন্তু দীর্ঘ ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এই তদন্ত এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
আরও পড়ুন: দেবুর কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনায় স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি
দলীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি দেবুর চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি মহলের চাপে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ দেবুর বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
সূত্রটি জানায়, চাঁদাবাজির মামলাটি দেবুর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদ হারানোর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। চার্জ গঠনের পর থেকে তিনি মামলাটি মীমাংসা করতে উঠেপড়ে লাগে। শেষ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একটি পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা একজন প্রভাবশালী নেতার মধ্যস্থতায় মামলাটি মীমাংসা করতে যাচ্ছেন।
দেবাশীষ নাথ দেবু শিক্ষা উপমন্ত্রী ও নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী।
২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় দেবাশীষ নাথ দেবুসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছিলেন বন্ধন নাথ নামে এক কুয়েত প্রবাসী। তিনি এখন কানাডায় থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায়। দেবাশীষ নাথ দেবু হলেন বন্ধন নাথের ভাগিনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে নগরীর ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের পাশে পুরনো একটি ভবনসহ ১২ কাঠা জায়গা কিনেছিলেন বন্ধন নাথ। এরপর তিনি ওই ভবনটি ভাড়া দেন। আত্মীয়তার সুবাদে দেবাশীষ নাথ দেবুকে ওই ভবনে আশ্রয় দেন তিনি।
কিন্তু সেখানে আশ্রয় পেয়ে রাতারাতি রূপ পাল্টে ভবনটির মালিক বনে যান দেবু! ভবনটির নাম দেন ‘দেব ভবন’। ভবনের ৩০টি কক্ষের ভাড়ার টাকা তিনি নিজের পকেটে ভরতেন।
প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের টাকায় কেনা জায়গাটি নিজের নিকটাত্মীয় ‘দখল করে ফেললে’ মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে বন্ধন নাথের।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বন্ধন নাথ সেই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেড’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্র করেন।
পরদিন তিনি ডেভেলপার কোম্পানিকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিতে গেলে তাতে বাধ সাধেন দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা। তারা বন্ধন নাথকে ভবনটির ভেতর আটকে রাখেন। এরপর তার কাছে তারা ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন।
কিন্তু তিনি চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা তাকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে বন্ধন নাথের পিঠের ডান পাশে গুলি করা হয়।
এরপর তারা ব্যবসায়িক লেনদেন বাবদ বন্ধন নাথের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওনা আছে বলে জোরপূর্বক তিনটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।
এ ঘটনার তিনদিন পর বন্ধন নাথ আসামিদের ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। চাঁদা দেওয়ার পর প্রাণনাশের হুমকির ভয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি দেশ ছেড়ে কুয়েতে পালিয়ে যান।
আরও পড়ুন: স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবুর চাঁদাবাজি, গোপন ক্যামেরায় ধরা
কিন্তু ৭০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েও ক্ষান্ত হননি দেবু ও তার সঙ্গীরা। দুই বছর পর ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি যখন ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন, তখন দেবুর নেতৃত্বে অন্য আসামিরা আবার সেখানে গিয়ে হানা দেন। নির্মাণ কাজে বাধা দিয়ে তারা আরও ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর সাগরিকা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দেবাশীষ নাথ দেবু।
গ্রেপ্তারের পর ওই বছরের ১৮ মার্চ জেলগেটে দেবাশীষ নাথ দেবু ও মঞ্জুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ালী উদ্দিন আকবর।
জিজ্ঞাসাবাদে দুই আসামি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাঁচটি চেকের মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন।
মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালের ৫ মে আসামি দেবাশীষ নাথ দেবু ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেডের কাছ থেকে একটি চেকে ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। সেই চেকটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী প্রাইম ব্যাংক শাখায় তার ব্যক্তিগত একাউন্টে (হিসাব নম্বর: ১৩৬২১০৮০০০১৫১৮) জমা হয়।
২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। গত বছরের ২১ আগস্ট এই মামলার চার্জ গঠনের মাধ্যমে আসামিদের বিচার শুরু করেন আদালত।