রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:২৬ : পূর্বাহ্ণ
নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মিছিলে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ও শটগানের পাশাপাশি চায়নিজ রাইফেল দিয়েও গুলি ছুঁড়েছে। ডিবি পুলিশের এসআই মাহফুজুর রহমান কনককে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে পরপর তিন রাউন্ড গুলি করতে দেখা গেছে। যদিও তার নামে কোনো রাইফেল ইস্যু করা ছিল না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কনকের নামে কোনো রাইফেল ইস্যু নেই, আছে পিস্তল। তিনি অন্য কারও রাইফেল দিয়ে গুলি ছুঁড়লে তা নিয়মের ব্যত্যয়।
বৃহস্পতিবারের ওই সংঘর্ষের সময় গুলিতে শাওন আহমেদ রাজা নামে এক যুবদল কর্মী নিহত এবং ২৫ জনের বেশি গুলিবিদ্ধসহ বহু নেতাকর্মী আহত হন। তবে শাওনের শরীরে বিদ্ধ বুলেট চাইনিজ রাইফেলের কি-না তা জানা যায়নি।
শাওনের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও তার ফেসবুকজুড়ে বিএনপির পক্ষে প্রচারণা ও দলটির নেতাদের ছবি দেখা গেছে।
নিহত শাওনের বড় ভাই বাদী হয়ে বিএনপির পাঁচ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাতে একটি মামলা করেছেন।
তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুলিশ তাকে মামলা করাতে বাধ্য করেছে। পাশাপাশি পুলিশের ওপর হামলা ও কর্তব্যে বাধার অভিযোগে পুলিশের একটি মামলায় ৮ শতাধিক লোককে আসামি করা হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১০ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালিতে সংঘর্ষ চলাকালে নগরের ২ নম্বর রেলগেটে পুলিশ বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে কনককে বিএনপি নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, ওই সময় এক পুলিশ কর্মকর্তা তাকে কোন দিকে গুলি করতে হবে, তা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
তবে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি) তারিকুল ইসলাম জানান, এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংঘর্ষ বেধে গেলে বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে সাধারণত শটগান ব্যবহার করতে দেখা যায়, যা দিয়ে রাবার বুলেট বের হয়। ডিবি কর্মকর্তার চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলির বিষয়টি তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমীর খসরু বলেন, বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সাত শতাধিক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।
শাওনের ফেসবুক ‘sawon ahmed’ (রাজা)’ নামে আইডিতে দেখা যায়, প্রথমেই লেখা রয়েছে- ‘কর্মীর চেয়ে বড় কোনো পদ নাই, সাক্ষী দেহের ঘামে ভেজা নগরীর রাজপথ, ফতুল্লা থানা যুবদল জিন্দাবাদ।’
তার আইডিতে বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদের একাধিক ছবি পোস্ট করা। গত ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে আজাদ ও কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য সাদিকুর রহমান সাদেকের সঙ্গে খিচুড়ি বিতরণের ছবি শাওনের আইডিতে রয়েছে।
গত ৩১ মে শাওন তার সর্বশেষ পোস্টেও আজাদ ও সাদেকের ছবি শেয়ার করেছেন। ছবিটির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘নিশি রাতের ভোট চোরদেরকে বলে দিও ২০২৩ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করব ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল নারায়ণগঞ্জ জেলা।’
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাওন যুবদলের রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তিনি যুবদলের কমিটিতে পদ পাওয়ারও চেষ্টা করছিলেন।
তবে তার চাচা ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বৃহস্পতিবার রাতে বলেছিলেন, ‘শাওন যুবলীগ কর্মী নয়, আবার যুবদল কর্মীও নয়।’
বৃহস্পতিবার বিএনপির মিছিলে সামনের সারিতে ছিলেন শাওন।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শওকত আলী বলেন, ‘তাকে নিজেদের কর্মী প্রমাণ করতে পারলে বিএনপির ফায়দা আছে। কিন্তু আমি বলবো, আমার সন্তান মারা গেছে। তার পরিবার যেন কোনো প্রতিহিংসার শিকার না হয়। নতুন করে এই পরিবারের লোকজন যেন ঝামেলায় না পড়ে। আমি চাই, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। ন্যায়বিচার হোক।’
শাওন কীভাবে মারা গেছে, তা নিশ্চিত করতে পারেননি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার ময়নাতদন্ত শেষ হয়।
তবে ময়নাতদন্তের বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ময়নাতদন্তে নিহতের শরীরে দুটি ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেলেও কোনো গুলি পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন তারা।
মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন ডা. মফিজ উদ্দিন। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ জানান, নিহতের বুকের বাম পাশে এবং পিঠের নিচের অংশে দুটি ক্ষত পাওয়া গেছে। গভীর ক্ষত দুটি। তবে শরীরে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি।
কী কারণে শাওনের মৃত্যু হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত বলা যাবে। ক্ষতগুলো কীসের সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গত ১ সেপ্টেম্বর একটি হত্যা মামলা করেছেন নিহত শাওনের বড় ভাই মো. মিলন হোসেন।
মামলায় কারো না উল্লেখ না করলেও তাতে দাবি করা হয়েছে, অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে তার ভাই মারা গেছে। স্বজনরা জানিয়েছে পুলিশের চাপে তিনি মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন।
এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে মিলন বলেন, ‘মৃত্যু যেভাবে লেখা ছিল, সেভাবেই হয়েছে। আমি আমার ভাইয়ের প্রকৃত খুনির বিচার চাই।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শাওনের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানিয়েছেন। তাদের স্বান্তনা জানাতে শুক্রবার দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি নিহতের বাড়িতে যান। সেখানে তিনি শাওনের মা ও দুই ভাইকে সমবেদনা জানান এবং দলের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা অনুদান দেন।