আবু সুফিয়ান, বয়স ৬০ বছর। বিএনপি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শাখার আহ্বায়ক। পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিরও সদস্য তিনি।চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তীতে উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তিনি। দক্ষিণ জেলা বিএনপির নেতৃত্বে আসা, গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া ও সাংগঠনিক নানা বিষয় নিয়ে আবু সুফিয়ান কথা বলেছেন রাজনীতি সংবাদের সাথে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজনীতি সংবাদের সম্পাদক সালাহ উদ্দিন সায়েম।
প্রশ্ন: নেতাদের কোন্দলের কারণে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আগের কমিটি ভেঙ্গে দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু আপনার নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার পরও নতুন করে কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ কী?
উত্তর: উপজেলা ও পৌরসভার কমিটি গঠন নিয়ে এই কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে। কিছু নেতা তাদের পছন্দমতো কমিটি করতে চায়। কিন্তু সংগঠন তো কারও মনমতো চলতে পারে না।
প্রশ্ন: দল থেকে বহিস্কার হওয়া যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আব্বাস এবং দুই সদস্য শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও লেয়াকত আলীর সাথে আপনার বিরোধের কারণ কী ছিল?
উত্তর: আনোয়ারা উপজেলার কমিটি গঠন নিয়ে আলী আব্বাসের সাথে আমার ও সদস্য সচিবের মতবিরোধ হয়েছিল। তিনি (আলী আব্বাস) চেয়েছিলেন আনোয়ারায় তার পছন্দমতো কমিটি করতে। কিন্তু দলের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাতে আপত্তি জানিয়ে ওই কমিটি অনুমোদন না দিতে আমাদের নির্দেশনা দেন। এরপর আলী আব্বাস আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পাল্টা কমিটি দেন।
প্রশ্ন: একটা ইউনিটের কমিটি নিয়ে মতবিরোধ হলে তারা সাতটা ইউনিটে পাল্টা কমিটি কেন দিলেন?
উত্তর: তারা বিদ্রোহ করার কারণে সঙ্গে আরও কিছু লোকজন রাখার জন্য সাতটা ইউনিটে পাল্টা কমিটি দিয়েছেন। কমিটি নিয়ে যারা অখুশি তারা তাদের সাথে ভিড়েছে। অথচ আমরা প্রথমে যে নয়টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করেছি, সেগুলোর সাথে পাল্টা কমিটির খুব একটা অমিল নেই। তারাও একই লোকদের কমিটিতে স্থান দিয়েছেন।
প্রশ্ন: কমিটি নিয়ে আপনাদের মতবিরোধ হয়েছে আলী আব্বাসের সাথে। কিন্তু তার সাথে শেখ মহিউদ্দিন ও লেয়াকত আলীসহ অনেক নেতা কেন যোগ দিলেন?
উত্তর: বাঁশখালী ও পৌরসভার কমিটিতে লেয়াকত আলী তার লোকদের পছন্দমতো পদ দিতে চেয়েছিলেন। সেটা আমরা না করায় তিনি অখুশি হন। আর শেখ মহিউদ্দিন কেন আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন তা জানি না।
প্রশ্ন: বহিস্কৃত তিন নেতার আর দলে ফেরার সুযোগ আছে?
উত্তর: প্রতিবাদের অনেক উপায় ছিল। তারা কেন্দ্রে লিখিতভাবে অভিযোগ জানাতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা না করে পাল্টা কমিটি দিয়ে পরিস্কার সংগঠনবিরোধী কাজ করেছেন। তারা দলের কেন্দ্রে শোকজের সন্তোষজনক জবাবও দিতে পারেননি। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ করে উল্টো তা ন্যায়সংগত বলার চেষ্টা করেছেন। তারা কেন্দ্রের কাছে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে হয়তো ফেরার সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন: কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বলছেন, তিনি দল থেকে বহিস্কার হলেও সাতটি ইউনিটে তার ঘোষিত পাল্টা কমিটিগুলো কেন্দ্র বাতিল করেনি। কমিটিগুলোর বৈধতা আছে বলে মনে করছেন তিনি। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উত্তর: কোনো সংগঠনে পাল্টা কমিটি বলে কিছু নেই। সাংগঠনিকভাবে এটার কোনো বৈধতা নেই। আর যেটা অবৈধ সেটা ভাঙার কথা আসবে কেনো? বিয়ে বৈধ না হলে তালাকের কথা তো আসে না।
প্রশ্ন: সম্প্রতি দক্ষিণ জেলার দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব। এর কারণ কী?
উত্তর: তিনি অনেক দিন ধরে অসুস্থ। সে কারণে দলীয় প্রোগ্রামে আসতে পারছেন না। সুস্থ হলে আসবে।
প্রশ্ন: কিন্তু নেতা-কর্মীরা বলছেন, পটিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকায় সদস্য সচিব তার সাথে বিরোধের জের ধরে সভা-সমাবেশে আসছেন না। আসলে কি তাই?
উত্তর: মোস্তাকের সাথে এনামের ব্যবসয়িক লেনদেন রয়েছে। ব্যবসায়িক কারণে তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়ে থাকতেই পারে। কিন্তু সেটার কারণে সদস্য সচিব কর্মসূচিতে না আসার তথ্যটা সঠিক বলে মনে করি না।
প্রশ্ন: দক্ষিণ জেলা বিএনপির ৩ মাসের আহ্বায়ক কমিটি ২ বছর পার করেছে। সম্মেলন আদৌ হবে কি?
উত্তর: বিভিন্ন গ্রুপ, বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঠেলাঠেলি, টানাটানির কারণে আমরা চাইলেও কমিটি করতে পারি না। এখন কেন্দ্র থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে বলা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সম্মেলন করতে আমরা চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন: বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থান আগের চেয়ে কি সুসংগঠিত হয়েছে?
উত্তর: আগের কমিটির নেতৃত্বে দক্ষিণ জেলা সফলভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারতো না। আমরা নেতৃত্বে আসার পর পুলিশি বাধার মুখেও প্রতিটি কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে আসছি। আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একসাথে কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। দুজন দুই মেরুতে ছিলেন। দুজন পাল্টাপাল্টি কমিটি দিয়েছেন। এমনকি একটা উপজেলায় তিনটা পাল্টাপাল্টি কমিটিও হয়েছে। যা সাংগঠনিক শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল না। এখন আমরা সংগঠনকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছি।
প্রশ্ন: দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে মহানগর থেকে কেন আপনাকে বেছে নেওয়া হলো?
উত্তর: দক্ষিণ জেলার নেতৃত্ব শূন্যতার কারণে কেন্দ্র থেকে আমাকে বলা হলো, দায়িত্ব নিয়ে সম্মেলনটা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমার সম্মতির জন্য কমিটি ছয়মাস ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে খসরু ভাই (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী) আমাকে ডেকে বললেন, ‘দক্ষিণ জেলার অবস্থা খুব খারাপ, তুমি দায়িত্বটা নিয়ে সম্মেলনটা করে দাও।’ তিনি বলার পর আমি রাজি হই।
প্রশ্ন: দক্ষিণ জেলার আহ্বায়কের দায়িত্ব আপনার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়াটা কি প্রত্যাশিত ছিল?
উত্তর: অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল। কারণ নির্বাচনের একবছর আগে বিএনপির উচ্চ পর্যায় থেকে আমাকে সিগন্যাল দিয়েছিল মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন: একই আসনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানও মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মনোয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কি নিশ্চিত ছিলেন?
উত্তর: বিএনপি-আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রার্থী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত মনোনায়ন নিয়ে কেউ নিশ্চিত হতে পারে না। বিএনপির সর্বশেষ প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয় চট্টগ্রাম-৮ আসনের। আসলে মোরশেদ খান যে মনোনয়ন পাবেন না তা উনি কল্পনাও করেননি। উনি মনোনয়ন না পাওয়ার আগে নির্বাচনী এলাকায় অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণাও শুরু করে দিয়েছিলেন। যেদিন মনোনয়ন দেওয়া হয় সেদিন রাত ১টা পর্যন্ত উনি গুলশান অফিসের দুইতলায় ছিলেন। আমি নিচতলায় ছিলাম। অবশ্য বিএনপি মহাসচিব উনাকে মনোনয়ন না দেওয়ার বিষয়ে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: মোরশেদ খানের মতো হেভিওয়েট নেতাকে বাদ দিয়ে আপনাকে মনোনয়ন দেওয়ার কারণ কী ছিল?
উত্তর: নির্বাচনে কোনো হেভিওয়েট প্রার্থী নেই। কোনো প্রার্থীর মাথার ওপর যখন ধানের শীষ কিংবা নৌকা প্রতীক দেওয়া হয় তখন হেভিওয়েট হয়ে যায়। নির্বাচনে আমি মাত্র ১ ঘণ্টায় ৬৬ হাজার ভোট পেয়েছি। যাদের হেভিওয়েট প্রার্থী বলা হয় তারা বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলে কারও জামানত থাকবে? আমার কর্ম দেখে দল মনোনয়ন দিয়েছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু দলীয় মহলে প্রচার ছিল যে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে মোরশেদ খানের দ্বন্দ্বের কারণে আপনাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এটা কতটুকু সত্যি?
উত্তর: দ্বন্দ্ব কেন থাকবে? হয়তো শারীরিক সক্ষমতা না থাকার কারণে উনাকে (মোরশেদ খান) মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উনি একটি মামলার কারণে দেশের বাইরে ছিলেন। তখন উনার বড় বোনকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা উঠেছিল। কিন্তু তখন উনার বড় বোনের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখন ম্যাডামকে (বিএনপি চেয়ারপারসন) বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম, মোরশেদ খানের বড় বোনকে নমিনেশন দিলে সাথে একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েন।’ পরে নমিনেশন দেওয়া হয় এরশাদ উল্লাহকে।
প্রশ্ন: মোরশেদ খানের সঙ্গে তো আপনার সুসস্পর্ক ছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর আপনাদের মধ্যে দূরত্বটা কীভাবে হলো?
উত্তর: আমি মনোনয়ন পাওয়ার পর ঢাকায় উনাকে (মোরশেদ খান) সালাম করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় গিয়ে ঢুকতে পারিনি। সেদিন রাতে আমি ঢাকায় হোটেলে থাকি। পরদিন আবার উনার বাসায় যাই। কিন্তু বাসায় ঢুকতে পারিনি। এরপর থেকে উনার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সম্পর্কে ফাটল ধরে।
প্রশ্ন: বিএনপি থেকে মোরশেদ খানের পদত্যাগ করার বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: উনি (মোরশেদ খান) বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু উনি দলের দুঃসময়ে কোনো ভূমিকা কোনো সময় রাখেননি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে উনি বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহকে ঠেকানোর জন্য মঈন উদ্দীন খান বাদলকে টাকা দিয়েছিলেন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আমাকে ঠেকানোর জন্য বাদল সাহেবকে টাকা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিনকেও টাকা দিয়েছিলেন এবং বলেছেন, আমি যেন বোয়ালখালীতে নামতে না পারি। উনার কিছু লোকজনকে দিয়েও আমার বিরুদ্ধে কাজ করিয়েছেন। এটা উনি খুব অন্যায় করেছেন।
প্রশ্ন: মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের কি কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
উত্তর: অবশ্যই আছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তো আমি নিজে স্বাক্ষী। উনি (মোরশেদ খান) আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে, ‘এরশাদকে হতে দেওয়া যাবে না। তোমার কী লাগবে? তোমার জন্য এতো পাঠাচ্ছি।’ আমি উনাকে বলেছিলাম, স্যরি।
রাজনীতি সংবাদ: আপনাকে ধন্যবাদ
আবু সুফিয়ান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন: গণভবনে কেউ ঢুকতে পারেনি বিধায় প্রশাসক পদে নিয়োগ পেয়েছি