নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি, কক্সবাজার প্রকাশের সময় :৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ৩:০১ : অপরাহ্ণ
কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অন্যতম শীর্ষ নেতা ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে হত্যার সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) জড়িত বলে দাবি করেছেন তার ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ।
তিনি অভিযোগ করেছেন, মুহিবুল্লাহর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ইস্ট-ওয়েস্ট ১ নম্বর ব্লকে অফিস করছিলেন মুহিবুল্লাহ। ওই সময় হঠাৎ একদল লোক এসে তাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে এপিবিএন সদস্যরা তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে ক্যাম্পের ‘এমএসএফ’ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এপিবিএন গণমাধ্যমকে জানায়, দুর্বৃত্তরা ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে, যার তিনটিই মুহিবুল্লাহর বুকে লাগে।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে তার পরিচিতরা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
ক্যাম্পে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন (এপিবিএন) ১৪-এর কমান্ডিং কর্মকর্তা পুলিশ সুপার নাইমুল হক বলেন, ‘হত্যাকারীরা মুহিবুল্লাহর কাছে যেতে পেরেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন। তাই তারা পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন বলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হচ্ছে।’
মুহিবুল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উখিয়া কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পে এশার নামাজ শেষ করে আমার ভাই আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর অফিসে যান। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে আমি সেখানে দ্রুত ছুটে গিয়ে দেখি, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমার ভাই পড়ে আছে। আর সেখান থেকে অস্ত্র হাতে মাস্টার আবদু রহিম ও মুর্শেদ, লালুসহ ১৫ থেকে ২০ জনকে বেরিয়ে যেতে দেখি। এ সময় তারা আমার দিকেও এক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তখন আমি সেখান থেকে পালিয়ে রক্ষা পাই।’
তিনি আরও বলেন, সেখানে আগেই উৎপেতে ছিলেন দুর্বৃত্তরা। প্রথমে তারা আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। তখন অফিসে কর্মরত অন্যান্যদের তারা ব্যাপক মারধর করে ছেড়ে দেন। এরপর মাস্টার আবদুর রহিম নামে এক সন্ত্রাসী আমার ভাইয়ের দিকে পরপর চার রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তিনটি গুলি লাগে তার বুকে, আর একটি ডান হাত ছেদ হয়ে বেরিয়ে যায়।
যারা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসা’র সদস্য বলে দাবি করেন হাবিবুল্লাহ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইতোপূর্বে মুহিবুল্লাহ নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাছাড়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তরান্বিত করতে বাংলাদেশ সরকারসহ এনজিও, আইএনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন এই নেতা। তার এই ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় রোহিঙ্গা ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আরসাসহ অন্যান্য গ্রুপগুলো। এ কারণে তাকে খুন করা হয়েছে বলে দাবি স্বজনদের।
মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে মংডু টাউন শিপের সিকদার পাড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পে আসেন মুহিবুল্লাহ।
এরপর তিনি মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। মুহিবুল্লাহ সংগঠনটির চেয়ারম্যান ছিলেন।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের ভাষ্যমতে, শরণার্থী শিবিরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া তুলে ধরতো মুহিবুল্লাহর এই সংগঠন।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ পান মুহিবুল্লাহ। সেসময় হোয়াইট হাউসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও সাক্ষাত করেন তিনি। এরপর থেকে মুহিবুল্লাহ গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন।
২০১৯ সালের ২২ আগস্ট কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মহাসমাবেশ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন মুহিবুল্লাহ।
হত্যাকাণ্ডের বিচার চান ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা। তাদের অনেকে মুহিবুল্লাহকে মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন আখ্যা দিয়ে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার এক টুইটে লিখেছেন-‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের একজন সাহসী চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে শোকাহত ও বিচলিত। আমি তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই এবং আশা করি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে।’
ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন টুইট করেছেন-‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত ও শোকাহত। তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য এটি এক মর্মান্তিক ক্ষতি। আমার আন্তরিক সমবেদনা।’
আরও পড়ুন: মুহিবুল্লাহর জানাজায় হাজারো মানুষ, শোকে কাতর রোহিঙ্গারা