শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

চট্টগ্রামের সিআরবিতে ইউনাইটেডের হাসপাতাল প্রকল্পে শুভংকরের ফাঁকি



নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :১৫ জুলাই, ২০২১ ৮:৫৭ : অপরাহ্ণ

দেশের যে কোনো শহরে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ২ একর জমি থাকতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই নীতিমালা ফাঁকি দিয়ে চট্টগ্রামের সিআরবিতে (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) রেলওয়ের কাছ থেকে ছয় একর জমি লিজ নিয়ে ১০০ শয্যার বেসরকারী মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারী ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারী-বেসরকারী চুক্তির আওতায় সেখানে মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল ও ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।

২০২০ সালের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড হাসপাতালের সঙ্গে রেলওয়ের সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী এখন প্রকল্পের নির্মাণ কাজের প্রস্তুতি চলছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত জমিতে প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।

সিআরবি রেলওয়ে হাসপাতাল, পাশের খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং এই সড়কের দুপাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার (একতলা সেমিপাকা) নিয়ে মোট ছয় একর জমিতে হাসপাতালটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে ওই প্রকল্প এলাকা থেকে আটটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আরও অন্তত তিনশ পরিবার উচ্ছেদের অপেক্ষায় রয়েছে। উচ্ছেদের আওতায় রয়েছে মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, কবরস্থান এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভবনও। প্রায় একশ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে তৈরী করা হয়েছে রাস্তা। কেটে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েকটি গাছ। এ প্রকল্প এলাকায় নৌবাহিনীর একটি স্থাপনাও রয়েছে।

প্রস্তাবিত এই ছয় একর জমির বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি শতবর্ষী শিরীষ ও সেগুন গাছ। এছাড়া পুরো এলাকায় পাহাড় ও টিলা ঘিরে রয়েছে সেগুন, কড়ই, মেহগনিসহ নানা জাতের তিনশর বেশি গাছ। এ হাসপাতাল করতে গেলে কমপক্ষে তিন শতাধিক গাছ কাটা যাবে। কাটা যাবে একটি পাহাড়ও।

ব্রিটিশ আমলের বহু স্মৃতিবিজড়িত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক স্থান সিআরবিকে বলা হয় চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’। নগরীর একমাত্র উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ হিসেবে ভ্রমণের জন্য মানুষ নিত্যদিন সিআরবিতে ছুটে যান। সিআরবির পাহাড় ও বৃক্ষছায়ায় গিয়ে প্রশান্তি খোঁজে মানুষ। এছাড়া সিআরবিতে বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত অনুষঙ্গ পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসব ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক আয়োজনও হয়ে থাকে।

ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ সিআরবিতে বাণিজ্যিক হাসপাতালের মতো স্থাপনা নির্মাণ করা নিয়ে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।

গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক, পরিবেশবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা এই হাসপাতাল প্রকল্পের বিরোধিতা করে নানা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন। তারা সিআরবিতে বেসরকারী এ হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

কিন্তু চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিকের আপত্তি উপেক্ষা করে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালটির প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আহসান জাবির সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। এর বাইরে আর কোনো বক্তব্য নেই।’

গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তিতে মো. আহসান জাবির বলেছেন, হাসপাতাল শিরীষতলায় নয়, গোয়ালপাড়ায় হবে। এতে সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হবে না। পাহাড়-টিলা অক্ষত রেখেই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। ৫০ বছর পর হাসপাতালটি রেলওয়ের নিকট হস্তান্তর করবে। এ প্রকল্প নিয়ে যা বলা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

হাসপাতাল প্রকল্প পরিচালক এমনটা দাবি করলেও এর পেছনে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। একদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা উপেক্ষা করে হাসপাতালটির সাথে ১০০ শয্যার বেসরকারী মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ বেসরকারী মেডিকেল কলেজ স্থাপন করতে হলে তা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমিতে করতে হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব (চিকিৎসা শিক্ষা অনুবিভাগ) মো. শাখাওয়াত হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘গণমাধ্যমের খবরে জেনেছি, চট্টগ্রামে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড রেলওয়ে থেকে ৬ একর জমি লিজ নিয়ে হাসপাতালের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজও নির্মাণ করবে। কিন্তু তারা তো জমি লিজ নিয়ে মেডিকেল কলেজ করতে পারে না। মেডিকেল কলেজের স্থাপনায় প্রতিষ্ঠানের দুই একর নিজস্ব জমি থাকতে হবে। তারা আমাদের কাছে এ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো আবেদন করেনি। আবেদন করলে তখন আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

শুভংকরের ফাঁকি আছে আরও। হাসপাতাল প্রকল্প পরিচালক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, ৫০ বছর পর হাসপাতালটি রেলওয়ের নিকট হস্তান্তর করবে। কিন্তু হাসপাতাল চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে এমন কোনো দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পের নজির নেই যে, লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, এটা রেলওয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধোকাবাজি।

হাসপাতালটি ৬ একর জায়গায় নির্মাণ করার কথা বলা হলেও এ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে আরও অনেক স্থাপনা। বিশেষ করে ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালকে ঘিরে সেখানে গড়ে উঠবে ওষুধের দোকান ও খাবারের দোকান। এছাড়া রোগীদের থাকার জন্য অবকাঠামোও গড়ে উঠবে। থ্রি স্টার মানের এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দূর দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের গাড়ির বহরে প্রতিনিয়ত যানজট লেগে থাকবে সিআরবি ও আশেপাশের এলাকায়।

এজন্য চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিক, পরিবেশবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, সিআরবিতে বাণিজ্যিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হলে সেখানে একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হবে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনও হুমকির মুখে পড়বে।

চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিক ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘সিআরবিতে হাসপাতাল হলে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। রেলওয়ে নাকি বলছে, হাসপাতালটি হবে গোয়ালপাড়ায়, যেখানে পাহাড়-টিলা অক্ষত রেখেই এই হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। এটা কোনো কথা হলো? গোয়ালপাড়া কি আমরা চিনি না? সেখানে পরিচ্ছন্ন সমতল ভূমি কোথায় আছে? আর তারা কোথায় সেন্টার করে হাসপাতালের জন্য ৬ একর জায়গা নেবে?’

তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘চট্টগ্রামে এখন ইমপেরিয়াল, এভারকেয়ার ও ল্যাব এইডের মতো তিনটি থ্রি স্টার মানের বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে। চট্টগ্রামে কেন আরও একটি বেসরকারী হাসপাতাল দরকার হবে?’

চট্টগ্রাম মেডেকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র সিআরবিতে হাসপাতাল হলে চারদিকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে। এতে সিআরবির পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যসেবা বিপন্ন হবে। এটা অযোক্তিক সিদ্ধান্ত। স্বাস্থ্য সেবার চেয়ে মানুষের সুস্থ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ।’

ফৌজদারহাট বক্ষব্যাধি হাসপাতাল

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে হাসপাতাল করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। চট্টগ্রাম শহরের অদূরে ফৌজদারহাট রেলওয়ের একটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে প্রায় ১০ একর জমি রয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রকল্পটি সেখানে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।’

এ বিষয়ে জানতে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

চিরসবুজ সিআরবির বুকে হাসপাতাল নির্মাণ না করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ আটজনকে বিবাদী করে ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশ (লিগ্যাল নোটিশ) জারি করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনসহ ৬টি সংগঠন।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম জিয়া হাবিব আহসান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট ও গাছ নিধন করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সংবিধানের ১৮-ক ও ২৪ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। যেখানে পরিবেশ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানসমূহকে সংরক্ষণের কথা স্পষ্ট বলা আছে।’

সিআরবি ‘ঐতিহ্যবাহী স্থান’ হিসেবে বন্দরনগরীর মহাপরিকল্পনায় ‘সংরক্ষিত এলাকা’ হওয়ায় সেখানে বাণিজ্যিক হাসপাতাল স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে সিআরবি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে আছে। এটা সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় আমরা নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেখানে কোনো বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমোদন দেবো না। ঐতিহ্যবাহী স্থানে কর্মাশিয়াল কিছু করার সুযোগ নেই।’

সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গতকাল বুধবার (১৪ জুলাই) প্রকল্প এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু প্রকল্প এলাকাটি পরিদর্শনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। নেতাদের কেউ হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে, আবার কেউ পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প পরিদর্শন করেন আওয়ামী লীগ নেতারা

পরিদর্শনে যাওয়া দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের আগে আমরা একসাথে সার্কিট হাউজে বসে আলোচনা করেছি। প্রকল্প পরিদর্শনের পর যৌথভাবে বিবৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে দেখলাম, তারা বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলা শুরু করেন। কেউ হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে, আবার কেউ পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, চট্টগ্রামবাসী না চাইলে সিআরবিতে হাসপাতাল হবে না।’

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর