নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :২৩ জুন, ২০২১ ৯:৩০ : পূর্বাহ্ণ
আন্দোলন, সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ৭৩ বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগ নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একটানা ক্ষমতায়। দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন উন্নত বিশ্বের কাতারে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু ১৯৪৯ সালে, পাকিস্তান সৃষ্টির দুবছর পার না হতেই। শুরুতে ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সব ধর্মের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে ১৯৫৫ সালে।
দল গঠনের ভাবনার শুরু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উদারপন্থী নেতাদের নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তার বীজটি রোপিত ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। ঢাকার কেএম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
সভাপতি মাওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের ৪০ জনের কমিটিতে কারাগারে থেকেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
এই দলটিই তখন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, রাস্ট্রভাষা বাংলা, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরকরাসহ নানা দাবিতে এগুতে থাকে।
পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচনে শেখ মুজিব ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগেকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অন্যদলকে সাথে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলে আওয়ামী লীগ প্রধান দল হিসেবে অবস্থান নিশ্চিত করে।
এরপর ধীরে ধীরে এগুতে থাকে বাংলার স্বাধীনতা দিকে। ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিব উপস্থাপন করেন স্বাধীন বাংলার মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয়দফা।
শেখ মুজিবকে দমাতে তাকে প্রধান আসামী করে পাকিস্তান সরকার দায়ের করে আগরতলা যড়ষন্ত্র মামলা। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন তীব্র হয়ে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথানে রূপ নেয়।
৭০ এর নির্বাচনে ভুমিধস জয় পায় আওয়ামী লীগে। দলের প্রধান শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানী জান্তা সরকার তার হাতে ক্ষমতা না দিলেও তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান চলতে থাকে তারই নির্দেশে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। ২৫ মার্চ পাকিস্তানীরা গণহত্যা শুরু করলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে রাস্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় সরকার।
নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ৭২ এর ১০ জানুয়ারী দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। শুরু করেন দেশ পূর্ণগঠনের কাজ।
১৯৭৫ এ একদল সেনাসদস্য হত্যা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির পিতা শেখ মুজিবকে। পাকিস্তানি কায়দায় দেশে শুরু হয় সেনাশাসন। নানা বাধার মুখে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শুরু করে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন।
ঘাত-প্রতিঘাত শেষে ক্ষমতার পালাবদলের পর ১৯৯৬ সালে শাসন ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। ২০০৭ এ আবার সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে বন্দি করে রাখে এক বছর।
জনগণের অব্যাহত দাবির মূখে মুক্তি পেয়ে ২০০৮ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আবারো ক্ষমতায় ফেরে। সেই থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্টজনরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের অর্জন পাকিস্তান আমলের গণতান্ত্রিক মানুষের অর্জন, এই দলের অর্জন বাংলাদেশের অর্জন। জাতির জন্য যখন যা প্রয়োজন মনে করেছে, সেটি বাস্তবায়ন করেছে এ দলটি। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, সব আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ গঠনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর থেকে দেশবিরোধীদের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে এসে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ দল সম্পর্কে মন্তব্যে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ শুধু দেশের পুরোনো ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলই নয়, এটি হচ্ছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের মূলধারাও। প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আমাদের সমাজ-রাজনীতির এ ধারাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নিচ্ছে। তিনি এ দলটিকে দেশের অন্যতম প্রাচীন সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ভাষা, স্বাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অর্জনে মহোত্তম গৌরবে অভিষিক্ত আওয়ামী লীগের কয়েক দশকের অভিযাত্রায় শান্তি, সমৃদ্ধি ও দিন বদলের লক্ষ্যে অবিচল বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী।
ইতিহাসবিদ, লেখক ও লোক সাহিত্যিক শামসুজ্জামান খান এই দলকে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, আওয়ামী লীগ ‘পাকিস্তান’ নামের অবৈজ্ঞানিক এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে এক উদ্ভট রাষ্ট্রের পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে অবজ্ঞায়, অবহেলায় ও ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ-পীড়ন-দমন ও ‘দাবিয়ে রাখা’র বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বিপুল জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দল। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, ’৬৪-এর দাঙ্গার পর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ২৪ বছরের আপোষহীন সংগ্রাম-লড়াই এবং ১৯৭১ সালের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ তথা সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি:
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর দলটির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এবারও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থবিধি মেনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- বুধবার সূর্যোদয়ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সব কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৯টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বিকেল ৩টায় ২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আলোচনা সভা হবে। সভায় গণভবন প্রান্ত থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।