রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২ এপ্রিল, ২০২১ ১১:৩০ : পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে ঘিরে গত সপ্তাহের শুরুতে টানা তিন দিন বিক্ষোভ এবং ব্যাপক সহিংতার পর পরিস্থিতি এখন অনেকটাই শান্ত। যদিও কয়েকদিন বিরতি দিয়ে আজ শুক্রবার আবারো বিক্ষোভের কর্মসূচি আছে সংগঠনটির।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হেফাজত এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে একধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহাবস্থান থাকলেও মোদী ইস্যুতে সেখানে ভাটা পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
সংঘাতের জন্য হেফাজত তাদের ভাষায় সরকারি দল ও আইন-শৃংখলা বাহিনীর আক্রমণকে দায়ী করছে। অন্যদিকে সহিংসতার পর কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারী দিচ্ছে সরকার। কিন্তু দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পরিস্থিতি এতো দ্রুত এমন সংঘাতপূর্ণ কীভাবে হয়ে উঠলো আর রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে-তা নিয়ে এখন চলছে নানা বিশ্লেষণ।
পরিস্থিতি কেন সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠলো?
গেলো শুক্রবার ও এর পরের তিন দিন হেফাজতে ইসলামের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী কর্মসূচিকে ঘিরে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। যদিও হেফাজত বলছে, এ সংখ্যা ১৮ জন।
কর্মসূচিকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারিতে। অভিযোগ রয়েছে হেফাজতের কর্মীরা এসব এলাকায় ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে।
শুক্রবার হেফাজতের প্রথম কর্মসূচি ছিলো ঢাকায় বাইতুল মোকাররম এলাকায়। হেফাজত বলছে, সেই বিক্ষোভে তাদের ভাষায় সরকারি দলের কর্মীদের হামলার কারণে বিক্ষোভ ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে।
হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব নাছির উদ্দীন মুনীর বলেন, ‘বাইতুল মোকাররমে আমাদের কর্মসূচি স্বাভাবিক-শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে আওয়ামীলীগের লোকজন এসে প্রথমে হামলা করে। মসজিদে ঢুকে মুসল্লীদের পেটানো হয়েছে। মূলত মসজিদে ঢুকে যেভাবে হামলা করা হয়েছে, সেটার কারণেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে সবখানে।’
তিনি বলেন, ‘যদি সরকার এবং দলীয় লোকেরা আমাদের বাধা না দিতেন তাহলে অপ্রীতিকর কোন পারিস্থিতি তৈরি হতো না। তারা সবখানে বাধা দিয়েছে এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী গুলি চালিয়েছে। সুতরাং এর দায় তাদেরই নিতে হবে।’
বাংলাদেশে মোদী বিরোধী বিক্ষোভেরও আগে সম্প্রতি ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলনে দেখা গিয়েছিলো হেফাজতে ইসলামকে। তবে সেসময়ের তুলনায় এবার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে ছিলো সরকার। দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও সক্রিয় ছিলেন রাজপথে। তবে পরিস্থিতির অবনতির জন্য হেফাজত সরকার ও সরকারি দলকে দায়ী করলেও আওয়ামী লীগ এর বিপরীত মতই দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘পুলিশ তো সংঘাত করেনি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও হামলা করেনি। বাইতুল মোকাররমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হেফাজতের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ঘটেছে। পুলিশ অ্যাকশন নিয়েছে। কিন্তু হাটহাজারিতো কিছু হয়নি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তো কিছু হয়নি। কেন তারা সেখানে তাণ্ডব করেছে। তারা থানা লুট করতে গেছে। তাহলে পুলিশ কী করবে? পুলিশ তো আত্মরক্ষার জন্যেই কঠোর হয়েছে।’
হেফাজত-সরকার সম্পর্ক কি ভেঙ্গে গেলো?
২০১৩ সালে বাংলাদেশের এই ইসলামপন্থী দল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির পর পরবর্তী বছরগুলোতে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
হেফাজতের আন্দোলনের পর সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানো, পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি পারিবর্তন, কওমীর দাওরায়ে হাদীসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া সেটারই প্রতিফলন বলে মনে করা হয়।
সরকারের সঙ্গে এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংগঠনটির প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফি এবং বিশেষত তার ছেলে আনাস মাদানীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
কিন্তু দৃশ্যপটে বড় পরিবর্তন আসে যখন আহমদ শফির মৃত্যুর পর আনাস মাদানী ও তার সমর্থকদের সরিয়ে বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। যাদের অনেকেই সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত।
ফলে হেফাজত এবং সরকারের মধ্যে যে একধরণের সহাবস্থান এবং সম্পর্ক ছিলো সেটার অবনতি সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করা হচ্ছিলো।
কিন্তু সেটা যে এতো দ্রুত ঘটবে সেটা বোঝা যায়নি।
রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন অবশ্য সম্পর্ক একেবারেই ভেঙ্গে গেছে- সেটা মনে করেন না।
তিনি বলেন, ‘জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে নতুন হেফাজত কমিটি দায়িত্ব নিয়েই তাদের একটা অবস্থান এবং শক্তির জানান দেয়ার চেষ্টা করছিলো। তাদের প্রথম কর্মসূচি ছিলো মুজিব ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান। তারা সরকারের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেছে। এটা সরকারের জন্য অনেক অস্বস্তিকর ছিলো। কারণ নতুন কমিটি নিয়ে সরকারের মধ্যে অবিশ্বাস আছে, যেহেতু সংগঠনের অনেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নেতা। আবার মোদী বিরোধী বিক্ষোভের সময় সরকার কঠোর অবস্থান নিয়ে হেফাজতকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। কারণ মাঠে হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও তাদের নেতাদের নামে কোন মামলা হয়নি।’
জোবাইদা বলেন, ‘এর মাধ্যমে সরকার এখনো তাদের সুযোগ দিচ্ছে, সরকার বিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার। সুতরাং সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু ঘণিষ্ঠতার মাত্রায় একটা হয়েতো পরিবর্তন আসতে পারে।’
তবে হেফাজত নেতা নাছির উদ্দীন মুনীর আবার বলছেন, ‘তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য নেই।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এরকমটা বলা যাবে না। আমরা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমাদের ধর্মভিত্তিক কিছু দাবী-দাওয়া থাকবে বা ইসলাম বিরোধী কিছু ঘটলে আমরা এর প্রতিবাদ করবো।’
অন্যদিকে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার নমনীয় আচরণ করছে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ সেটা নাকচ করে দিচ্ছেন। তার ভাষায়, ‘হেফাজতের সঙ্গে সরকার কিংবা দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সমঝোতায় বিশ্বাসী নয়।’
তবে সম্পর্কের মাত্রায় পরিবর্তন হোক বা না হোক, একটা টানাপোড়েন যে তৈরি হয়েছে সেটা স্পষ্ট।
কী ঘটতে পারে সামনে?
হেফাজতের বিভিন্ন স্তরে কথা বলে বোঝা গেছে, সংগঠনটি বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান এবং শক্তি ভবিষ্যতেও জানান দেবে। এমনকি মোদী বিরোধী বিক্ষোভে হেফাজত কর্মীদের প্রাণহানির প্রতিবাদে আরো কর্মসূচি দেয়ার পক্ষেও জোরালো মতামত আছে সংগঠনটিতে।
আবার তেমনটা হলে সরকারও কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়ে রেখেছে।
রাজনীতির বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ‘সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক বড় ধরণের অবনতি ঘটলে সেটা বাংলাদেশের রাজনীতির সমীকরণকেই ওলট-পালট করে দেবে।’
তিনি বলেন, ‘হেফাজতের মধ্যে একটা রাজনীতির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কারণ সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্তর্গত। সংগঠনটিকে ঘিরে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলোর একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবার সম্ভাবনা আছে, যদি তারা সেটা চায়। ফলে সরকারের চোখ কিন্তু এখন শুধু আর হেফাজতের বাউন্ডারির মধ্যে নেই। এখানে মূল জায়গায় হেফাজত থাকলেও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কী করছে, তার উপরই নির্ভর করবে হেফাজত কি বিভক্ত থাকবে নাকি ইউনাইটেড ফোর্স হিসেবে আবির্ভূত হবে।’
সূত্র: বিবিসি