রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৯ মার্চ, ২০২১ ১১:৫৫ : পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশে গত তিন দিনের সহিংস বিক্ষোভে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম এলাকায় সংঘর্ষের শুরু, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই তা সবচেয়ে ব্যাপক সহিংস রূপ পেয়েছে।
যে ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা গেছে তার মধ্যে ৮ জনই এই জেলার। সেখানে রবিবার সারা শহরের বহু সরকারি দপ্তর, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বনিক পাড়ায় নিজেদের ঘরের ভেতরে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল একটি পরিবার।
দুই সন্তানের জননী পরিবারের গৃহকত্রী তার ঘরে রবিবারের হামলার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা ভবনটির নিচের তলায় থাকি। আমাদের এসে বলেছে আপনারা বের হয়ে যান, আমরা আগুন দিয়েছি। কিন্তু দরজা খুলে বের হবো সেই সাহস হচ্ছিল না। দরজার সামনেই আগুন।’
ভবনের বাইরে বের হতে না পেরে ৯০ বছর বয়সী শাশুড়িকে তিনি ও তার স্বামী পাজাকোলা করে পাঁচতলা ভবনের ছাদে উঠে যান।
তিনি বলেন, ‘ধোঁয়ায় পুরো ভবন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমার একটি বাচ্চা প্রতিবন্ধী। ধোঁয়ার মধ্যে বাচ্চাদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
রোববারের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যে ধরনে সহিংসতা দেখা গেছে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছেন স্থানীয় সাংবাদিক মাশুক হৃদয়।
তিনি বলছিলেন, ‘হামলাকারীরা এমন একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল যে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির লোকজন সবাই মারাত্মক আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল।’
যে ধরনের হামলা হয়েছে
অন্য অনেক জেলা শহরের মতো একটি সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। সড়কটির নাম টি-এ রোড।
শহরের যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তার সব কিছুই এই সড়কের দুই ধারে অবস্থিত।
স্থানীয় প্রশাসন, সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে জানা গেছে টি-এ রোডের দুই ধারে জেলা সদরের পৌর সভা, শিল্পকলা, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, পৌর মিলনায়তন, ভূমি অফিস, প্রেস ক্লাব ছাড়াও আরও বেশ কিছু সরকারি ভবনে একে একে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বেলা এগারোটা থেকে চলতে থাকে তাণ্ডব।
একটি ট্রেনে হামলা করা হয় যেটি এর আগের দিন পুড়িয়ে দেয়া রেল স্টেশন পার হচ্ছিল।
আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এক আইনজীবী বর্ণনা করছিলেন শহরের কালী মন্দিরে তিনি কি দেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘কালীমন্দিরের দিকে গিয়ে দেখি সেখানে লুটপাট চলছে। লুটপাট বলতে মন্দিরের মূর্তিগুলো ভাঙা হচ্ছে আর দান বাক্সগুলো খোলা হচ্ছে এবং কোথাও কোন স্থানে পুলিশ ছিল না। তারা থানাতেই অবস্থান করছিল। দুইটা জল কামান ছিল সেই দুটো পুড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এগুলো রক্ষায় তাদের কোন সেলফ ডিফেন্স ছিল না। এই সবকিছুর ভিডিও আছে আমাদের কাছে।’
যেভাবে শুরু রোববারের সহিংসতার
জেলার একশ বছরের পুরনো জামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসায় শনিবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে হামলা করা হয়েছে বলে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকরাও এরকম একটি হামলার কথা উল্লেখ করে বলছেন, এতে সেখানে আরও বেশি ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মুফতি এনামুল হক অভিযোগ করেছেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একশ বছরের পুরনো একটা মাদ্রাসা আছে জামিয়া ইসলামি ইউনুসিয়া মাদ্রাসা। সেখানে যখন ছাত্রলীগের মিছিল থেকে আক্রমণ করা হয়, তখন এই কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষ ক্ষেপে যায়।’
তবে এত ঢালাও অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের দায় অস্বীকার করেছেন তিনি।
মুফতি এনামুল হক বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের মূল কর্মসূচী ছিল মোদীর আগমন নিয়ে। কিন্তু কিছু রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় এমপির দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষজন আঙুল তুলছে যে ওনার ইঙ্গিতে এসব হয়েছে। ভাঙচুরের জন্য হেফাজতে ইসলাম জড়িত না। যারা আগের দিন মাদ্রাসায় আক্রমণ করেছে তারাই আমাদের নামে বদনাম ছড়ানোর জন্য এসব হামলা চালিয়েছে।’
সংসদ সদস্যের যা বক্তব্য
শহরে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরের দায় যেমন নিচ্ছে না হেফাজতে ইসলাম, তেমনি যে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংগঠনটি অভিযোগ তুলেছে তিনিও পাল্টা অভিযোগ করছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের অধীনে রয়েছে সদর এলাকা। এই আসনের সংসদ সদস্য ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরীর নেতৃত্বেই শনিবার সন্ধ্যার মিছিলটি বের হয়েছিল।
তিনি বলছেন, সেই মিছিল মাদ্রাসা এলাকায় কোনমতেই প্রবেশ করেনি।
সংসদ সদস্য ওবায়দুল মুক্তাদির বলছেন, ‘তাদের এসব অভিযোগের আদৌ কোন সত্যতা নেই। মিছিল একটা হয়েছিল। আগের দিন বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙেছে, প্রশাসন ও পুলিশের কার্যালয়ে হামলা করেছে, রেল স্টেশন পুড়িয়েছে, এসব কারণে আমরা একটা প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম। এই মাদ্রাসার এলাকায় প্রবেশ করেনি। আমি একেবারে চ্যালেঞ্জ করে বলছি। তাদেরকে (হেফাজতে ইসলাম) আমি বলবো মিথ্যার আশ্রয় যেন তারা না নেন।’
তবে তিনি বলছেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল কোন একটি গোষ্ঠী যাদের দুরভিসন্ধি আছে, তারা হয়ত বা মিছিলের পেছন থেকে ঢুকে থাকতে পারে। তবে সেটা আমার জানার কথা না, কারণ আমি শরীর খারাপ থাকায় মিছিল শেষ হওয়ার আগেই বের হয়ে যাই।’
ঠিক গতকালই বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, হামলার ধরন দেখে মনে হয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা এই পরিস্থিতির সাথে সম্পৃক্ত। যাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে জামায়াত শিবির।
এত ধ্বংসযজ্ঞ তাহলে কোন তৃতীয় পক্ষ চালাল তার জবাব মিলছে না কারো কাছেই। সে নিয়ে কথা বলার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কারো কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে বেশ হামলার শিকার হয়েছে জেলার পুলিশ।
রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলে হাইওয়ে পুলিশের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে সেখানকার পুলিশের সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছে সোমবার সারাদিন। কিন্তু তাদের তরফ থেকেও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা