রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন
প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ ২০২১, ৬:৩০ অপরাহ্ণ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) ক্যাম্পাসের কর্তৃত্ব নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। বেসরকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) আসনের সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীকে সভাপতি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন দেয়। নবগঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আগের বোর্ডের সদস্যরা। যা নিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি-পাল্টা বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
বায়তুশ শরফের পীর মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী গত ৪ মার্চ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীকে সভাপতি করে আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন দেওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপ-মন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি নবগঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
আবদুল হাই নদভীর প্রকাশিত এই বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদ জানিয়ে আইআইইউসির আগের ট্রাস্টি বোর্ড পরদিন ৫ মার্চ পত্রিকায় পাল্টা বিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি আ ন ম শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড আইনসিদ্ধ বৈধ পর্ষদ।’
সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী আইআইইউসির আগের ট্রাস্টি বোর্ডের বিজ্ঞপ্তির প্রতিবাদে পরদিন ৬ মার্চ পত্রিকায় পাল্টা প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি দেন। বিজ্ঞপ্তিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আইআইইউসির বাতিলকৃত ট্রাস্টি বোর্ড পত্রিকায় প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। নবগঠিত আইআইইউসি ট্রাস্টিজের পক্ষে বায়তুশ শরফের পীরের নামে বিজ্ঞপ্তিটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে প্রচার করা হয়েছে।’
তবে সাংসদ আবু রেজা নদভী রাজনীতি সংবাদের কাছে দাবি করেছেন, পত্রিকায় তার নামে যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে সেটা তিনি নিজে দেননি। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তিটা আমি ডাইরেক্ট দিইনি। এটা অন্য জায়গা থেকে দেওয়া হয়েছে।’
গত ৬ মার্চ সীতাকুণ্ডের কুমিরায় আইআইইউসির ক্যাম্পাসে গিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা করেন সাংসদ আবু রেজা নদভী ও বায়তুশ শরফের পীর মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী। তবে ওই সভায় অংশ নেননি আইআইইউসির উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, রেজিস্ট্রার এবং ফিন্যান্স ডিরেক্টর।
একই দিন আইআইইউসির আগের ট্রাস্টি বোর্ড সভাপতি আ ন ম শাসশুল ইসলাম ভার্চুয়ালি এক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, নবগঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের আইনগত বৈধতা নেই।
জানা গেছে, রোববার (৭ মার্চ) আইআইইউসির নব গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের আইনগত বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে একটা রিট করেছে আগের ট্রাস্টি বোর্ড।
করোনার কারণে আইআইইউসির ক্যাম্পাস এখনও বন্ধ। কিন্তু ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় ৪৩ একর জমির ওপর গড়ে উঠে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় নিজস্ব ক্যাম্পাসের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও দুটি ক্যাম্পাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আইআইইউসির ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের ক্যাম্পাস দুটি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। এখন শুধুমাত্র সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে পাঠদান চলছে।
এ ক্যাম্পাসে আছে ৪৬টি ভবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীনে ১১টি বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী আছে।
গত ২৬ বছর ধরে ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়ে আসছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বায়তুশ শরফের পীর মরহুম শাহ মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার।
জানা গেছে, বায়তুশ শরফের পীর আবদুল জব্বার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর তাফসির মাহফিলের নিয়মিত উদ্বোধন করতেন। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ আয়োজিত এই তাফসির মাহফিলে তিনি উদ্বোধক হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন। বায়তুশ শরফের বর্তমান পীর মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী হলেন আবদুল জব্বারের ছেলে। আবদুল হাই নদভী গত ৪ মার্চ চট্টগ্রামের পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেন, আইআইইউসি জামায়াত ইসলামী ও যুদ্ধাপরাধী শক্তির নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
জানা গেছে, আবু রেজা নদভী সাংসদ হওয়ার আগে আইআইইউসির দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। সাংসদ হওয়ার পরও তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর আ ন ম শামসুল ইসলামের সাথে বিভিন্ন সেমিনার ও সিন্ডিকেট সভায় অংশ নিয়েছেন। চট্টগ্রামের কুমিরায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস উদ্বোধনের সময় আবু রেজা নদভী তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সাথে গাড়িতে চড়ে সেখানে যান।
উল্লেখ্য, জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য মরহুম মুমিনুল হক চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে করেন সাংসদ নদভী।
গত ৬ মার্চ সাংসদ আবু রেজা নদভী পত্রিকায় দেয়া প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করেন, ‘আইআইইউসির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি একাধিক মামলার চার্জশিটভুক্ত ও দন্ডিত আসামি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর আ ন ম শামসুল ইসলাম, সদস্য জামায়াত নেতা আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া ও আমিরুজ্জামান কি স্বাধীনতাবিরোধী নন?’
আইআইইউসির আগের ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, সাংসদ নদভী নিজের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করার জন্য জামায়াত নেতাদের বিরোধিতা করছেন। অথচ জামায়াতের সাবেক দুই আমির (মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া) গোলাম আজম ও মতিউর রহমান নিজামীর সাথে তার সখ্যতা ছিল। এমপি হওয়ার পরও তিনি আইআইইউসিতে এসে আ ন ম শামসুল ইসলামের সাথে বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে কোনো ট্রাস্টি বোর্ডকে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধন নিতে হয়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০১০ সালে আইআইইউসির যে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন হয়েছে, তা জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে এখনও নিবন্ধিত। এই ট্রাস্টি বোর্ডের এখন ১৪ জন সদস্য রয়েছে। চার বছর অন্তর গত তিন মেয়াদে এই ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা আইআইইউসি পরিচালিত হয়ে আসছে। গত মাসে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ডের মেয়াদ রিনিউ করা হয়। সাংসদ নদভী গত মাসে জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের জন্য আবেদন করলেও তা খারিজ করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি আগের ট্রাস্টি বোর্ড বাতিল করে দিয়েছে। তাদের মেয়াদ রিনিউ করা হয়নি।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইনগতভাবে কারা বৈধ আর কারা অবৈধ সেটা সামনে কোর্টে প্রমাণ হবে। তখন আপনারা দেখবেন।’
যৌথমূলধন কোম্পানি (জয়েন্ট স্ট কোম্পানি) ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপ নিবন্ধক মো. হারুন অর রশীদ রাজনীতি সংবাদকে জানিয়েছেন, আইআইইউসির আগের ট্রাস্টি বোর্ডের নিবন্ধন এখনও আছে।
তিনি বলেন, ‘আইআইইউসির আগের যে ট্রাস্টি বোর্ড ছিল, সেটা এখনও বলবৎ আছে। তারা গত মাসে মেয়াদ রিনিউ করেছে। তাছাড়া একটা ট্রাস্টি বোর্ড দ্বারা পরিচালিত সম্পত্তি অন্যজনের নামে নিবন্ধনের আইনগত কোনো সুযোগ নেই।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে আইআইইউসির নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদন দিয়েছে?
শিক্ষা উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল রাজনীতি সংবাদকে এর ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে-‘আইআইইউসিতে জামায়াত ইসলামীর যে ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে, ইসলামী শিক্ষা ট্রাস্ট নামে অনেক আগের একটা সোসাইটি সেটা রেজিস্ট্রেশন করেছে। সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন করা মানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক না। আর সোসাইটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিবে বিশ্ববিদ্যালয় কারা পরিচালনা করবে? বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবে ওরাই, যারা প্রতিষ্ঠাতা করেছে। আইআইইউসির প্রতিষ্ঠাতা হলো বায়তুশ শরফের পীর জব্বার সাহেব। তার ছেলে ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী গঠিত ট্রাস্টের সদস্য। সেই ট্রাস্টকে আমরা রেজিস্ট্রেশন দিতে যাচ্ছি।’