রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ৭:৩০ : অপরাহ্ণ
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের বাড়িটি দখলমুক্ত করে নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত বাড়িটির জায়গায় ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণ করবে সরকার। এ লক্ষে ভবনটির সামনের ভেঙে ফেলা অংশে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।
শনিবার (২৩ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারের নেতৃত্বে প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়ে এ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি আবুল মোমেন ও মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় সরকারের নির্দেশে এই পদক্ষেপ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়িটি দখলমুক্ত করার পর আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় সংবিধানের ২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে তারা বাড়িটি রক্ষা করেছেন। সেখানে জাদুঘর করার পরিকল্পনা আছে।
এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) বদিউল আলম বলেন ‘এটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা। চট্টগ্রামের ইতিহাসের সাথে জড়িত। কিছু দুষ্কৃতকারীরা অবৈধ অনুপ্রবেশ করে বাড়িটি ভাঙচুর করে। এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা সংবিধানের ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সাংবিধানিক দায়িত্ব। হাইকোর্টের আদেশ এবং সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুসারে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে আমরা এটার দায়িত্ব নিয়েছে। এটা রক্ষা করেছি। জাদুঘর করার বিষয়টি প্রাথমিক পর্যায়ে। ২০১৮ সালের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সভায় এ বাড়ির স্মৃতি সংরক্ষণের সিদ্ধান্তও আছে। পরিকল্পনা আছে জাদুঘর করার।’
এখন থেকে বাড়িটিতে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং এর পাহারায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকবে বলেও জানান তিনি।
ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত রহমতগঞ্জে ১৯ গণ্ডা জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ওই জমিটি পরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষিত হয়। বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের পরে বেদখল হয়। পরে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নিয়ে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি সেখানে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৪ জানুয়ারি সকালে এম ফরিদ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির ছেলেরা আদালতের আদেশ নিয়ে বাড়িটির দখল নিতে আসেন। পুলিশের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের নাজির আমিনুল হক আকন্দ ‘দখল পরোয়ানা’সহ কাগজপত্র নিয়ে তাদের বাড়িটি বুঝিয়ে দেন। দুপুরে বুলডোজার দিয়ে ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি ভাঙা শুরু হলে কবি আবুল মোমেন ও অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তের নেতৃত্বে স্থানীয়রা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা ঐতিহাসিক এই ভবনটি না ভেঙে সংরক্ষণের দাবি জানান।
গত ৬ জানুয়ারি জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ির দখল ও অবস্থানের উপর স্থিতাবস্থা জারি করেন। ঐতিহাসিক বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণ করার ব্যর্থতাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ওই স্থাপনাকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
জেলা প্রশাসনের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে ৭ জানুয়ারি যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি ভাঙার উপর নিষেধাজ্ঞা দেন চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত।
এরমধ্যে যাত্রামোহন সেনগুপ্তের বাড়ি রক্ষায় চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ, রাজনীতিক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ আন্দোলনে নামেন। ঐতিহাসিক এই ভবনটিকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হিসেবে নির্মাণের দাবিও জানান তারা।
সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ভবনটি পরিদর্শন শেষে এটি রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। এর মধ্যেই শনিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাড়িটি দখলমুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হলো।