রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬:০১ অপরাহ্ণ
মাসে দেড় কোটি টাকার বেশি আয় করে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনকে করের আওতায় নিয়ে এসেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ৪৯ বছরের এই সংগঠনটির এতোদিন টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) সার্টিফিকেট ছিল না। সম্প্রতি এনবিআর নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটির টিন রেজিস্ট্রেশন করেছে। এরপর চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগ সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনকে তাদেরকে ফাঁকি দেওয়া কর পরিশোধের জন্য রিটার্ন দাখিল করতে নোটিশ পাঠিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-১ এর উপকমিশনার (সার্কেল-৬) হুমায়ুন কবির রাজনীতি সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
হুমায়ুন কবির রাজনীতি সংবাদকে জানান, আমরা কয়েক দফায় চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনকে টিন রেজিস্ট্রেশন ও রিটার্ন দাখিল করতে নোটিশ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা অগ্রাহ্য করে। এরপর বিষয়টি আমরা এনবিআরকে অবহিত করি। এরপর এনবিআর আয়কর আইন ২০২৩ এর ১৮৪ ধারা অনুযায়ী নিজ উদ্যোগে সংগঠনটির টিন রেজিস্ট্রেশন করেছে।
এনবিআর কোন প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের টিন রেজিস্ট্রেশন করেছে-জানতে চাইলে এই কর কর্মকর্তা বলেন, ‘সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন থেকে নিবন্ধন নিয়েছিল। এই নিবন্ধন নম্বর দিয়ে এনবিআর তাদের টিন রেজিস্ট্রেশন করেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সংগঠনটির আয়কর প্রদানের অনেকগুলো খাত আছে। এর মধ্যে প্রধান খাত হলো সংগঠনটির নিজস্ব সম্পত্তি ও ব্যাংকের এফডিআর।’
জানা গেছে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে নোটিশ পাঠানো হয়। ২২ দিনের মধ্যে তাদেরকে রিটার্ন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটিকে ২০১৮-২০১৯ করবর্ষ থেকে ৬ বছরের ফাঁকি দেওয়া কর পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর পরিশোধ না করলে আয়কর বিভাগ নিজ উদ্যোগে সংগঠনটির কর নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি তাদেরকে জরিমানা ও দণ্ড আরোপ করবে।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুন সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। এই সংগঠনটি চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, শাহ আমানত বিমানবন্দর ও প্রাইভেট কনটেইনার ডিপোতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট ও শুল্ক পরিশোধ ছাড়াও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। চট্টগ্রাম নগরীর শেখ মুজিব সড়কের সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ারের ১৪ তলায় সংগঠনটির কার্যালয়। ১৪ তলা বিশিষ্ট এই সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ারের মালিক হলো সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ এই ব্যবসায়ী সংগঠনটি মাসে দেড় কোটি টাকার বেশি আয় করে। তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো চট্টগ্রাম বন্দরের অন চেসিস ডেলিভারি। প্রতি মাসে এই খাত থেকে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা আয় হয়। সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ার থেকে বছরে আয় হয় প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সংগঠনটির ব্যাংকে এফডিআর আছে প্রায় ৫১ কোটি টাকা। নগরীর আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের পাশে ২৩.৬৯ শতক জায়গায় সিঅ্যান্ডএফ প্রজেক্ট-২ নামে ২৩ তলা বিশিষ্ট আরও একটি বহুতল ভবন গড়ে তুলছে সংগঠনটি।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই সংগঠনটি মাসে দেড় কোটি টাকার বেশি আয় করেও বছরের পর বছর ধরে সরকারকে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আসছে। এ নিয়ে গত ২ ডিসেম্বর রাজনীতি সংবাদে ‘মাসে দেড় কোটি টাকা আয় করে কর দেয় না চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর টনক নড়ে চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগের। প্রতিবেদন প্রকাশের তিনদিনের মাথায় গত ৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনকে নোটিশ পাঠায় আয়কর বিভাগ। এতে সংগঠনটিকে একদিনের মধ্যে টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) রেজিস্ট্রেশন ও আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নোটিশ পাওয়ার পর সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন থেকে সংগঠনটির আইন সম্পাদক নগরীর আগ্রাবাদে আয়কর অফিসে গিয়ে নানা অজুহাত দেখিয়ে টিন রেজিস্ট্রেশন করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। এরপর আয়কর বিভাগ সংগঠনেকে কয়েক দফায় নোটিশ পাঠিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন আয়কর বিভাগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এরপর চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগ এনবিআরের দ্বারস্থ হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা রাজনীতি সংবাদকে বলেন, বিগত কমিটির সাধারণ সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক ও আইন সম্পাদক চট্টগ্রাম কর বিভাগকে দম্ভ দেখিয়েছিলেন। তারা ট্যাক্স না দিতে চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগকে নানা অজুহাত দেখিয়ে আইনের মারপ্যাঁচে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন নিজেরাই মারপ্যাঁচে পড়েছে। গাধা জল ঘোলা করে খায়, সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনেরও একই অবস্থা হয়েছে।
চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, আয়কর না দিতে সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন আমাদের দম্ভ দেখিয়েছিল। তারা আমাদেরকে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা করেছে। মনে হয়, এনবিআরের ক্ষমতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। এর আগে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কর ফাঁকি দিতে চেষ্টা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত তারা নত হয়ে কর পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে।
আরও পড়ুন:
মাসে দেড় কোটি টাকা আয় করে কর দেয় না চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশন
‘চাপে’ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স দিলো চট্টগ্রাম চেম্বার
চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি উধাও!