বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ২২ মাঘ, ১৪৩১ | ৫ শাবান, ১৪৪৬

মূলপাতা আঞ্চলিক রাজনীতি

ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতির মাঠে সাঈদ আল নোমান, নানা জল্পনা



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬:১০ অপরাহ্ণ

সাঈদ আল নোমান তূর্য, চট্টগ্রামের বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের সন্তান। চট্টগ্রাম নগরীর খুলশীতে অবস্থিত বেসরকারী ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। আমেরিকার সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটি, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করে তিনি চট্টগ্রামে এসে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি এই ইউনিভার্সিটির গণ্ডির মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। সম্প্রতি উচ্চশিক্ষিত এই তরুণ ইউনিভার্সিটির আঙিনা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছেন। যা নিয়ে চট্টগ্রাম নগর বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা জল্পনা চলছে।

সাঈদ আল নোমান গত ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে রাজনীতির মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে পা রাখেন। ওই দিন তিনি নগরীর হালিশহর নয়াবাজার বিশ্বরোড মোড়ে তার বাবা বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে বিজয় মিছিলে অংশ নেন। এরপর থেকে তিনি কখনো এককভাবে, আবার কখনো আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর-পাহাড়তলী-খুলশী) আসনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তার তৎপরতা চোখে পড়ার মতো।

বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, সাঈদ আল নোমান চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের মতো ভোটের রাজনীতি শুরু করেছেন। দলীয় কোনো নেতাকর্মী কিংবা নেতাকর্মীদের স্বজন মারা গেলে তিনি ছুটে যান সেখানে। এরপর লাশের খাট কাঁধে তুলে নেন। এম এ লতিফও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর এই কৌশলে ভোটের রাজনীতি শুরু করেন। এই কায়দা অবলম্বন করে তিনি খুব অল্প সময়ে মানুষের নজর কাড়েন।

বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, মূলত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন সাঈদ আল নোমান। চট্টগ্রাম-১০ আসনে যে কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি ছুটে যাচ্ছেন।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে শাসনামলে চট্টগ্রাম নগরীতে বিএনপির রাজনীতির মাঠে সাঈদ আল নোমানের কোনো তৎপরতা ছিল না। বিএনপির দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাকে দেখা যায়নি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি থেকে খোলস ছেড়ে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েন। তবে তিনি এখনো পর্যন্ত কোনো সভা-সমাবেশে নির্বাচন করার কথা বলেননি। এমনকি আবদুল্লাহ আল নোমানও সভা-সমাবেশে তার ছেলে নির্বাচন করার ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি।

চট্টগ্রাম-১০ আসনের আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, আবদুল্লাহ আল নোমানের বয়স এখন ৮৩ বছর। বয়সের কারণে রাজনীতির মাঠে আগের মতো সক্রিয় থাকতে পারেন না তিনি। দলীয় কর্মসূচিতে তাকে এখন খুব একটা দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি তার ছেলে সাঈদ আল নোমানের জন্য ভোটের মাঠ ছেড়ে দিতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাঈদ আল নোমান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন, আমি যেন নির্বাচন করি। তাদের এই আকাঙ্খা অস্বাভাবিকও না। তবে এই মুহূর্তে আমি মনোনয়ন-নির্বাচন নিয়ে কোনো চিন্তা করছি না। মনোনয়ন দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতির মাঠে নেমেছি। আমার বাবার ৬৮ বছর এবং আমার দাদা ও প্রতিতামহ ১৫০ বছর রাজনীতি-সমাজসেবা করেছেন। বংশ পরম্পরায় আমিও মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতির মাঠে নেমেছি, শুধু নমিনেশনের জন্য নয়।’

গত ৫ জানুয়ারি আবদুল্লাহ আল নোমান ছেলে সাঈদ আল নোমানকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ নিয়ে চট্টগ্রাম নগর বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে তখন নানা কথা চাউর হয়।

বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকে দাবি করছেন, আবদুল্লাহ আল নোমান মূলত আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ছেলে সাঈদ আল নোমানকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এই সাক্ষাৎ করেছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাঈদ আল নোমান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমার বাবার কোনো কথা হয়নি। আমার বাবা ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খবর নিতেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।’

তবে রাজনীতির মাঠে সাঈদ আল নোমানের তৎপরতা নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় অনেকে তার প্রশংসা করছেন, আবার অনেকে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর শামসুল আলম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘সে উচ্চশিক্ষিত, রাজনীতি বুঝে, সভা-সমাবেশে সুন্দর বক্তৃতা করতে পারে। আমাদের সঙ্গে নির্বাচন করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছে। তার বাবার আসনে নির্বাচন করলে অসুবিধা কোথায়?’

তবে সাঈদ আল নোমানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শাহীন আহমেদ নামের আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী এক বিএনপি নেতা। তিনি নগরীর হালিশহর থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।

শাহীন আহমেদ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘গত রোববার পাহাড়তলী গ্রিনভিউ এলাকায় এক যুবদল নেতার মায়ের জানাযায় আসার কথা ছিল সাঈদ আল নোমানের। কিন্তু তিনি এসেছেন জানাযা শেষে দেড় ঘণ্টা পরে। জানাযা শেষে লোকজনকে আমি সাঈদ আল নোমানের জন্য অপেক্ষা করতে বলি। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবাই চলে যায়, কেবল আমরা ১০-১২ জন নেতাকর্মী ছিলাম। এ ঘটনার পর আমি যা বুঝার বুঝে গেছি।’

কী বুঝলেন-এ প্রশ্নের জবাবে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘মানুষের কাছে তার (সাঈদ আল নোমান) গ্রহণযোগ্যতা নেই। একজন নেতা আসবেন, মানুষকে দেড়-দুই ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখবেন, এটা তো রাজনীতি হলো না।’

নেতাকর্মীদের অনেকে আবার আবদুল্লাহ আল নোমানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন।

নগরীর উত্তর কাট্টলী এলাকার নগর যুবদলের একজন সাবেক সহসভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, গত ৬ বছর ধরে এই এলাকায় আবদুল্লাহ আল নোমানের কোনো তৎপরতা ছিল না। দলীয় নেতাকর্মীদের তিনি কোনো খবর রাখেননি। আমি প্রায় ১ মাস অসুস্থ ছিলাম, তিনি আমারও কোনো খবর নেননি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর-পাহাড়তলী-খুলশী) আসনে বিএনপির প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এবারও জটিলতা দেখা দিতে পারে।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর-পাহাড়তলী-খুলশী) আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মোশারফ হোসেন দীপ্তিকে ডিঙিয়ে মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম-১০ আসনেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

দলীয় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, আমীর খসরু আসন্ন সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়ন চাইবেন না। তিনি এবার কেবল চট্টগ্রাম-১০ আসনে মনোনয়ন চাইবেন।

এ বিষয়ে জানতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল প্রেয়ার ব্রেকফাস্ট’ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ওয়াশিংটন গেছেন।

চট্টগ্রাম-১০ আসনের বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, আমীর খসরু যদি এবার কেবল চট্টগ্রাম-১০ আসনে মনোনয়ন চান, তাহলে আবদুল্লাহ আল নোমান বিপাকে পড়ে যাবেন। তখন তিনি নিজে মনোনয়ন চাইবেন নাকি ছেলের জন্য চাইবেন? আবদুল্লাহ আল নোমান মনোনয়ন চাইলেও এবার বয়সের কারণে না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর যদি সাঈদ আল নোমান মনোনয়ন চান তাহলে তিনি আমীর খসরুর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। এমনকি আবদুল্লাহ আল নোমানও যদি মনোনয়ন চান, তিনি এবার আমীর খসরুকে ঠেকাতে পারবেন না। কারণ ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে দলের আন্দোলন-সংগ্রামে আমীর খসরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি জেলও কেটেছেন। কিন্তু সেই সময় আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন নিস্ক্রিয়।

দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম-১০ আসনে আমীর খসরু বাধা হয়ে দাঁড়ালে সাঈদ আল নোমান চট্টগ্রাম-৯ আসনের (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) দিকে পা বাড়াতে পারেন।

ভোটের রাজনীতিতে পারদর্শী আবদুল্লাহ আল নোমান ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার কোতোয়ালী আসনে নির্বাচন করেন। এরমধ্যে ১৯৯১ সালে তার কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী প্রয়াত সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু সাবেক মন্ত্রী নোমান ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ এই আসন ছেড়ে চলে যান পাহাড়তলী-হালিশহরে। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে কোতোয়ালী আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান বর্তমান সিটি মেয়র ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন।

আরও পড়ুন: নোমানের ‘আশীর্বাদে’ চট্টগ্রাম নগর বিএনপির নেতৃত্বে এরশাদ উল্লাহ-নাজিমুর রহমান!

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর