শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১৭ মাঘ, ১৪৩১ | ৩০ রজব, ১৪৪৬

মূলপাতা জাতীয়

ব্রিগেডিয়ার আযমীকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা


সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক
প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২:১৮ অপরাহ্ণ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর প্রয়াত গোলাম আজমের মেজ ছেলে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে হত্যার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা সরাসরি গুম-খুনের নির্দেশদাতা ছিলেন।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

গত ২৭ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভ্যুলুশন-এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে তুলে নেওয়া হয়। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার দিকে রাজধানীর বড় মগবাজারের বাসা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাকে আটক করা হয়।

পরে আযমীকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আটকের বিষয়টি একাধিকবার দাবি করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।

হাসিনার পলায়নের পর আযমীসহ অনেকে আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়ে দীর্ঘ ৮ বছর পর গত ৭ আগস্ট বাড়ি ফিরেন আযমী।

এক সেনা কর্মকর্তার বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আয়নাঘরে আযমীর বন্দি থাকা ও তার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়ে শেখ হাসিনা সরাসরি অবগত ছিলেন।

তিনি (আযমী) ফেলো মিলিটারি অফিসার হওয়ায় তার মুক্তির বিষয়ে বারবার শেখ হাসিনার কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি (শেখ হাসিনা) আযমীকে হত্যার পরামর্শ দেন।

ওই কর্মকর্তা জানান, আমি তেমনটি করিনি। তবে এরপর আমি তার মুক্তির বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেই।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি এবং পুলিশসহ নিরাপত্তাভিত্তিক সব প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে উল্লেখ করে এর পাশাপাশি বিচার বিভাগের সংস্কারের কথাও বলা হয়েছে।

নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের নির্যাতন বা ক্ষমতার অপব্যবহার অংশে গুম তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের কমিশন গঠনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কমপক্ষে ৩ হাজার ৫০০ মানুষকে গুম করা হয়েছে। এজন্য কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামো ছিল। যার দেখাশোনা করতেন শেখ হাসিনা নিজে ও তার শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এ তালিকায় অন্যতম ব্যক্তিরা হলেন-মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম এবং মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার নিষ্পেষণমূলক হাতিয়ারের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা পর্যায়ক্রমে বিরোধীদলীয় নেতা, সাংবাদিক, সমালোচক ও মানবাধিকার কর্মীদের টার্গেট করেছে। এজন্য মিথ্যা মামলা, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, খেয়ালখুশিমতো গ্রেপ্তার এবং জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে।

গুমের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তারা এইচআরডব্লিউকে বলেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সিনিয়র সদস্যরা আটকের বিষয়ে জানতেন। তবে বিষয়টি প্রকাশ করা হতো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন।

নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং হত্যাকাণ্ড অংশে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরেই, জোরপূর্বক গুমের শিকার তিনজন- মাইকেল চাকমা, মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) এবং আবদুল্লাহিল আমান আজমী মুক্তি পান।

তিনজনের ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে তাদের আটক রাখার কথা অস্বীকার করে আসছিল। কিন্তু মুক্তির পর তারা সবাই সাংবাদিকদের নির্জন কারাগারে রাখার কথা জানিয়েছেন। এমনকি সেখানে অন্য বন্দিদের কথা শুনতে পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তারা।

২০১৬ সালের আগস্টে আযমী ও আরমানের সঙ্গে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে আটক করা হয়। তারা তিনজনই বিরোধী দলের নেতার ছেলে, যাদের পিতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মামকে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয় যে, তিনি তার বেআইনি আটকের বিষয়ে চুপ থাকবেন।

হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি কেবল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন। তিনি জানান, ‘আমি যে ভবনে ছিলাম সেখানে আরও অনেক কক্ষ ছিল। এসব বন্দীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। সেখানে অন্যান্য লোকও ছিল।

প্রতিবেদনে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেমের (আরমান) কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আরমান তার বাবার আইনজীবী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

২০১৬ সালের ৯ আগস্ট তাকে সাত-আটজন কর্মকর্তা, স্ত্রী, বোন এবং সন্তানদের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় আইনজীবী হিসেবে তিনি নিজের গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখতে চান। কিন্তু কর্মকর্তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাড়ি থেকে টেনে বের করে একটি ভ্যানে তুলে চোখ বেঁধে দেন। তিনি এসবের প্রতিবাদ করলে দয়া করে আমাদের আপনার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করতে বাধ্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন এক কর্মকর্তা।

গুমের সঙ্গে জড়িত এক শীর্ষ কর্মকর্তা আরমানের বিষয়ে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের। যখন তিনি তার ইউনিটে যোগদান করেছিলেন, তখন তাকে বলা হয়েছিল যে, আরমান, আযমী এবং হুমাম কাদের চৌধুরী বিরোধী দলের প্রথম সারির তিন নেতার সন্তান। তাদের মুক্তি দেয়ার যে কোনো সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।

আরমানের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরেক কর্মকর্তা তাকে আটকের বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তিনি আশঙ্কা করেন যে আদেশ অমান্য করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: ৮ বছর গুম থাকার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ব্রিগেডিয়ার আজমী

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর