রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ | ২১ পৌষ, ১৪৩১ | ৪ রজব, ১৪৪৬

মূলপাতা জাতীয়

অবশেষে জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন কাজী নজরুল ইসলাম


কাজী নজরুল ইসলাম

রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি ২০২৫, ৭:২৬ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের মানুষ কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে জানলেও তার কোনো দালিলিক স্বীকৃতি এতোদিন ছিল না। অবশেষে তাকে সেই স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত ২৪ ডিসেম্বর ওই গেজেট প্রকাশ হলেও বৃহস্পতিবার তা হাতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী।

কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, ‘এটা ভীষণ আনন্দের সংবাদ; খুব ভালো লাগছে। এই দাবিটি তো আমাদের অনেক দিনের। এটি বাস্তবায়ন হওয়ায় ভালো লাগছে। কাজটি বাস্তবায়নে যারা কাজ করেছেন, সবার প্রতি আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’

কাজী নজরুলকে ‘জাতীয় কবি’ স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে গত ৫ ডিসেম্বর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন থাকায় সেটি নিষ্পত্তি সাপেক্ষে গেজেট প্রকাশ করা হবে বলে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী বলেন, ‘আদালতের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেই গেজেট প্রকাশ হয়েছে। আমি নজরুল ইন্সটিটিউটের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছি। জুলাই গণঅভ্যুথানের স্পিরিট নিয়ে সরকার এই কাজটি করেছে। এটা আমাদের সবার জন্যই একটা ভালো খবর।’

কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে ২০২২ সালের ২২ জুন আসাদ উদ্দিনসহ সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী রিট আবেদন করেন।

নজরুলকে জাতীয় কবির ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে তখন রুল জারি করে হাই কোর্ট।

সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

গেজেট চাওয়ার যুক্তিতে ওই রিট আবেদনের বলা হয়, “কাজী নজরুল ইসলামের জাতীয় কবির মর্যাদার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত; রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও স্বীকৃত। এছাড়া বাংলাদেশের মানুষ তাকে জাতীয় কবি ঘোষণার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাশা করে।”

১৯৭২ সালের ৪ মে যে দিন কাজী নজরুল ইসলাম দেশে ফেরেন, গেজেটে সেদিন থেকে তাকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।

বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কলকাতা থেকে সরকারি উদ্যোগে সপরিবারে ঢাকায় আনা হয় এবং তার বসবাসের জন্য ধানমন্ডির ২৮ নম্বর (পুরাতন) সড়কের ৩৩০-বি বাড়িটি বরাদ্দ প্রদান করা হয়।

এরপর ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক সমাবর্তন উৎসবে এই উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অসুস্থতার জন্য নজরুলকে এ উৎসবে আনা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গভবনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ কাজী নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী নজরুলের উদ্দেশে একটি মানপত্রও পাঠ করেন।

কবি নজরুল ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। এই ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। পরবর্তীকালে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে সম্বোধন করে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮ জারি করা হয়।

১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতের কলকাতার এলবার্ট হলে সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এস. ওয়াজেদ আলী, দীনেশ চন্দ্র দাশসহ বহু বরণ্যে ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কাণ্ডারী’ এবং ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টারাও কবিকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত হলেও কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করে ইতোপূর্বে সরকারিভাবে কোনো গেজেট জারি করা হয়নি।

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর