রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:৩০ অপরাহ্ণ
চট্টগ্রাম নগরীর শেখ মুজিব সড়ক দিয়ে যাতায়াতের সময় আগ্রাবাদে যে কারও নজর কাড়ে দৃষ্টিনন্দন ১৪ তলা বিশিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ারটি। এই টাওয়ারের মালিক হলো চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। টাওয়ারের ১৪ তলায় সংগঠনটির কার্যালয়। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই ব্যবসায়ী সংগঠনটি মাসে দেড় কোটি টাকার বেশি আয় করে। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই সংগঠনটি সরকারকে কর দেয় না। ৪৯ বছরের এই সংগঠনটির টিন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) সার্টিফিকেটও নেই!
সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ার থেকে আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে চট্টগ্রাম কর অফিসের দূরত্ব হলো মাত্র ৩০০ মিটার। অথচ কর অফিসের কর্মকর্তারা জানেনই না, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বছরের পর বছর ধরে কর ফাঁকি দিচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ৩০ জুন সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স নেন। কিন্তু তাদের সংগঠনটি নিবন্ধন নিয়েছে শ্রম অধিদপ্তরের ট্রেড ইউনিয়ন থেকে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২৮০০ জন। এই সংগঠনটি চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, শাহ আমানত বিমানবন্দর ও প্রাইভেট কনটেইনার ডিপোতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট ও শুল্ক পরিশোধ ছাড়াও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস হলো চট্টগ্রাম বন্দরের অন চেসিস ডেলিভারি। এই সার্ভিসের জন্য বন্দর থেকে খালাস হওয়া প্রতি কনটেইনার বাবদ ৪০০ টাকা ফি নেয় সংগঠনটি। প্রতি মাসে এই খাত থেকে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা আয় হয় তাদের। ২০২৩ সালে অন চেসিস ডেলিভারি সার্ভিস থেকে ৮ কোটি ১১ লাখ ১৬ হাজার ৯০০ টাকা আয় করেছে সংগঠনটি।
এই ব্যবসায়ী সংগঠনটির আয়ের দ্বিতীয় বড় উৎস হলো ফটোস্ট্যট মেশিন খাত। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, শাহ আমানত বিমানবন্দর ও সিইপিজেডে প্রতিষ্ঠানটির ফটোস্ট্যট মেশিন রয়েছে। সংগঠনটি এই খাত থেকে বছরে কোটি টাকার বেশি আয় করে। ২০২৩ সালে আয় হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ২৭ হাজার ১৫৮ টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আয়ের তৃতীয় বড় উৎস হলো ব্যাংকের এফডিআর। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর আছে প্রায় ৫১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে এফডিআর থেকে মুনাফা হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এই ব্যবসায়ী সংগঠনটির আয়ের চতুর্থ বড় উৎস হলো সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ার। অ্যাসোসিয়েশনের অর্থায়নে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টাওয়ার থেকে ভাড়া বাবদ বছরে ৫ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ২০০৭ সাল হতে সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ারের স্পেস ভাড়া দেওয়া হয়। এই টাওয়ারে ৪০টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতি মাসে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালে সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ার থেকে ভাড়া বাবদ অ্যাসোসিয়েশন আয় করেছে ৫ কোটি ১০ লাখ ১৫ হাজার ১৮৯ টাকা।
অন চেসিস ডেলিভারি, ফটোস্ট্যট মেশিন, ব্যাংকের এফডিআর এবং সিঅ্যান্ডএফ টাওয়ার থেকে বছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা আয় হয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের। এ ছাড়া আরও বিভিন্ন খাত থেকে বছর কোটি টাকার বেশি আয় করে এই সংগঠনটি। সে হিসাবে বছরে ১৮ কোটি টাকার বেশি আয় করে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন।
বিভিন্ন খাত থেকে দিন দিন আয় বাড়ছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের। আয়ের টাকায় একের পর এক প্রকল্প গড়ে তুলছে সংগঠনটি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিঅ্যান্ডএফ প্রজেক্ট-২ নামে আরও একটি বহুতল ভবন গড়ে তুলছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। নগরীর আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের পাশে ২৩.৬৯ শতক জায়গায় নির্মাণ করা হবে ২৩ তলা বিশিষ্ট এই ভবন। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রায় ২৯ কোটি টাকা দিয়ে প্রকল্পটির জায়গা কেনা হয়েছে। গত বছর প্রকল্পটির নির্মাণ কাজের জন্য অ্যাসোসিয়েশন থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন-চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের চেয়েও আয় বেশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের। চট্টগ্রাম চেম্বারও বছরের পর বছর ধরে সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে আসছিল। এ নিয়ে গত বছরের ৯ অক্টোবর রাজনীতি সংবাদে ‘মাসে কোটি টাকা আয় করেও ট্যাক্স দেয় না চট্টগ্রাম চেম্বার’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগ। চট্টগ্রাম চেম্বার সরকারকে ট্যাক্স না দিতে নানা ‘অজুহাত’ দেখিয়েছিলো। কিন্তু চট্টগ্রাম আয়কর বিভাগের চাপে শেষ পর্যন্ত নমনীয় হয়ে গত বছর ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স পরিশোধ করে সংগঠনটি।
চট্টগ্রাম চেম্বারের মতো সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনও বছরের পর বছর ধরে সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে আসছে।
আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী, বাণিজ্য সংগঠনকে বার্ষিক আয় থেকে ২৭.৫ শতাংশ এবং স্থায়ী আমানত সুদহার (এফডিআর) থেকে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম আকতার হোসেন। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে। তাই এই বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ কে এম আকতার হোসেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের বিগত কমিটির পরিচালক ছিলেন। তিনি ‘আওয়ামী লীগপন্থী’ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তিনি চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর-পতেঙ্গা) আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চুও আত্মগোপনে চলে গেছেন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলুও দেশে নেই। তিনি কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন।
হোয়াটসঅ্যাপে কাজী মাহমুদ ইমাম বিলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আয়কর আইনে ব্যবসায়ী সংগঠনকে ট্যাক্স দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। আর চট্টগ্রাম চেম্বারও তো ট্যাক্স দেয় না। তাহলে আমরা কেনো দেবো?’
এরপর এই প্রতিবেদক তাকে আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী ব্যবসায়ী সংগঠনকে ট্যাক্স দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং চট্টগ্রাম চেম্বার ট্যাক্স পরিশোধ করার তথ্য তুলে ধরলে তিনি চুপ করে থাকেন। এরপর তিনি বলেন, ‘দেখি, কী করা যায়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-১ এর অতিরিক্ত কমিশনার মো. আশরাফুল ইসলাম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘ইতিপূর্বে আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী আমরা চট্টগ্রাম চেম্বারকে করের আওতায় এনেছি। চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের যদি করযোগ্য আয় থাকে, তাহলে তাদেরকেও করের আওতায় আসতে হবে। তারা এতো বছর ধরে কেন টিন সার্টিফিকেট করেনি, কেন কর পরিশোধ করেনি সেটা আমরা তদন্ত করে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।’
আরও পড়ুন:
‘চাপে’ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স দিলো চট্টগ্রাম চেম্বার
আড়াই ঘণ্টা অফিস করে বেতন নেন আড়াই লাখের ওপরে!