বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৮ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

আড়াই ঘণ্টা অফিস করে বেতন নেন আড়াই লাখের ওপরে!



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২১ নভেম্বর, ২০২৪ ১০:৩৮ : পূর্বাহ্ণ

তিনি অফিসে যান বিকেল ৪টার দিকে। আর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অফিস ত্যাগ করেন। মাত্র আড়াই ঘণ্টা অফিস করে মাসে বেতন নেন আড়াই লাখের ওপরে! আড়াই ঘণ্টার চাকরিতে প্রতি মিনিটে ১ হাজার ৭৭৭ টাকা আয় করেন তিনি।

এটি কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের চাকরি নয়, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সে এমন অবিশ্বাস্য বেতনে ‘রাজার হালে’ চাকরি করছেন প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ফারুক। বিষয়টি নিয়ে চিটাগাং চেম্বারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৩১ আগস্ট চিটাগাং চেম্বারে সেক্রেটারি ইঞ্জিনিয়ার ফারুককে লাঞ্চিত করেন একদল ব্যবসায়ী। এরপর তিনি গত আড়াই মাস ধরে চেম্বারে যাচ্ছেন না। চিটাগাং চেম্বার থেকে ‘বিতাড়িত’ হওয়ার পর তিনি কোর্ট বিল্ডিংয়ে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) আনোয়ার পাশার কার্যালয়ে গিয়ে অফিস শুরু করেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে আনোয়ার পাশা চিটাগাং চেম্বারের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন।

জানা গেছে, গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ফারুক চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) আনোয়ার পাশার কার্যালয়ে ফুল টাইম অফিস করতেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর থেকে তিনি সেখানে আড়াই ঘণ্টার বেশি অফিস করছেন না।

গতকাল বুধবার দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ফারুক রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমার নিয়োগকর্তা আছে। আমি তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবো। নিরাপত্তাজনিত কারণে আমি চেম্বারে যাচ্ছি না। তবে আমি চেম্বারে না গেলেও অনলাইনে অফিসারদের সঙ্গে প্রতিদিন মিটিং করি। আজকেও করেছি। তবে মিটিংয়ে দুষ্টচক্রের কাউকে রাখি না। কারণ তারা আমার স্ট্যাটাসের সাথে যায় না।’

প্রসঙ্গত, গত ২১ অক্টোবর রাজনীতি সংবাদে ‘৬ কোটি টাকার মালিক চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

চেম্বার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর সেক্রেটারি ফারুকের ‘আসল রূপ’ দেখে তার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন চিটাগাং চেম্বারের প্রশাসক আনোয়ার পাশা। এরপর থেকে তিনি ফারুককে ফুল টাইম অফিস করা থেকে বিরত রাখেন। বিকেল চারটার পর কেবল চেম্বারের বিভিন্ন ফাইলে সই করার জন্য তাকে অফিসে আসতে নির্দেশ দেন তিনি। এরপর থেকে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে আড়াই ঘণ্টা করে অফিস করছেন ফারুক।

আড়াই ঘণ্টা অফিস করেও ফারুক মাস শেষে পূর্ণ বেতন পকেটে ঢোকান। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে বিএসসি (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার) পাশ করা ফারুকের বেতন ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৪০ টাকা। ২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল চিটাগাং চেম্বারের অব কমার্সের মালিকানাধীন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আবাসিক ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) পদে ২৪ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। ৯ বছরের মাথায় তিনি চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেক্রেটারির চেয়ারে বসার পর ফুলেফেঁপে উঠে তার সম্পদ। জমি-প্লট কিনেছেন প্রায় ৩ কোটি টাকার, সঞ্চয়পত্র কিনেছেন প্রায় ১ কোটি টাকার, ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ১ কোটি টাকা, বানিয়েছেন কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ি। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় ৬ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।

 

চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর-পতেঙ্গা) আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও চিটাগাং চেম্বারের সাবেক সভাপতি এম এ লতিফের সহযোগী হিসেবে পরিচিত ইঞ্জিনিয়ার ফারুক। তিনি লতিফের ছত্রছায়ায় ও যোগসাজসে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ‘হরিলুট’ করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

চেম্বার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ফারুকের ‘দুর্নীতির’ বিষয়টি তদন্ত করার জন্য চেম্বার প্রশাসক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিটাগাং চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘তার (ফারুক) দুর্নীতির বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানিয়েছি। মন্ত্রণালয় হয়তো এখন এটার তদন্ত শুরু করতে পারে।’

জানা গেছে, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা চিটাগাং চেম্বারের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বেতন নেন না। বিনা বেতনে তিনি চেম্বারের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। চিটাগাং চেম্বারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নির্ধারিত বেতনে ফুল টাইম অফিস করছেন। অথচ চেম্বার সেক্রেটারি মাত্র আড়াই ঘণ্টা অফিস করে বেতন নেন আড়াই লাখের ওপরে।

চিটাগাং চেম্বারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলছেন, সেক্রেটারি ফারুক একজন অযোগ্য, অদক্ষ ও মহাদুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। তার ষড়যন্ত্রের কারণে চেম্বারের ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। তিনি সেক্রেটারির চেয়ারে বসার পর গত ৭ বছর ধরে চেম্বারে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তিনি এখন আড়াই ঘণ্টা অফিস করে ২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বেতন নিচ্ছেন; এটা কীভাবে সম্ভব? তাকে কেন চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে না? আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এম এ লতিফের সহযোগী হয়েও তিনি এখনো কীভাবে চাকরিতে বহাল আছেন?

ফারুককে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করেছেন চেম্বারের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সদস্যরা। গত ৩ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে চেম্বারের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের নেতারা সেক্রেটারি ফারুকের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্তের দাবি জানান।

আরও পড়ুন:

৬ কোটি টাকার মালিক চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি

চট্টগ্রাম চেম্বারের ভোটের লড়াইয়ে নামতে পারেন আলোচিত ৫ ব্যবসায়ী

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর