রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :১৫ নভেম্বর, ২০২৪ ৫:০৫ : অপরাহ্ণ
দীর্ঘ ১৭ বছর পর চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার প্যারেড ময়দানে আবার শুরু হতে যাচ্ছে ঐতিহাসিক তাফসীর মাহফিল। অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ’ পাঁচ দিনব্যাপী এই মাহফিলের আয়োজন করছে।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ জানিয়েছে, আগামী ২৭ জানুয়ারি থেকে এ তাফসীরুল কোরআন মাহফিল শুরু হবে; যা শেষ হবে ৩১ জানুয়ারি। আসরের নামাজের পর এই মাহফিলের আসর বসবে। মাহফিলে মহিলাদের জন্যও সুব্যবস্থা থাকবে।
২০০৬ সাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক এই তাফসীর মাহফিলের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বিশ্ববরেন্য মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মারা যান। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক এই তাফসির মাহফিলে আল্লামা সাঈদীর বিকল্প হিসেবে এবার তাফসির করবেন দেশের তুমুল জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। তবে তিনি এই মাহফিলে তাফসির পেশ করবেন কেবল পঞ্চম ও শেষ দিনে।
মিজানুর রহমান আজহারী এখন মালয়েশিয়ায় আছেন। চার বছর পর গত ২ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরেছিলেন। গত ১১ অক্টোবর তিনি আবার মালয়েশিয়ায় ফিরে যান।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই মাহফিলের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিকল্প হিসেবে মিজানুর রহমান আজহারীকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে আজহারীর জন্য এবারের তাফসিল মাহফিল হবে ‘টেস্ট কেস’। ৩৪ বছর বয়সী মিজানুর রহমান আজহারীর জনপ্রিয়তা থাকলেও হঠাৎ করে ঐতিহ্যবাহী এই মাহফিলে টানা পাঁচদিন বয়ান করা এবং শ্রোতাদের ধরে রাখা তার জন্য কঠিন হবে। এজন্য তাকে এবার একদিন বয়ান করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহফিলের আয়োজক ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ তাহের রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ আমাদেরকে আবার প্যারেড ময়দানে তাফসির মাহফিল পুনরুজ্জীবিত করার অনুরোধ করেন। আসলে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক এই তাফসীরুল কোরআন মাহফিলের সঙ্গে দেশের ধর্মপরায়ন কোটি কোটি মানুষের আবেগ-ভালোবাসা ও অনুভূতি জড়িত। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমরা আবার এই মাহফিলের আয়োজন করতে যাচ্ছি।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই মাহফিলে এবার টানা পাঁচ দিন আল্লামা সাঈদীর মতো কোনো প্রধান মুফাসসির থাকবেন না। দেশের আলোচিত বিভিন্ন আলেমরা বয়ান করবেন। মাহফিলের শেষ দিনে তাফসির করবেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজাহারী। তার বয়স কম। আল্লামা সাঈদীর মতো তিনি টানা পাঁচ দিন বয়ান করতে পারবেন না। এটা হবে তার জন্য টেস্ট কেস। এই মাহফিলে তার বয়ানে মানুষের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় আমরা দেখবো। যদি তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে পরবর্তী মাহফিলে তাকে দুই দিন বা তিন দিন তাফসিরের সুযোগ দেওয়া হবে। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে তিনি হয়তো আল্লামা সাঈদীর মতো এই মাহফিলের মধ্যমণি হবেন।’
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মৃত্যুর আগে দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে টানা পাঁচ দিন এই তাফসির মাহফিলে বয়ান করতেন। দরদমাখা হৃদয়স্পর্শী কণ্ঠে তার বয়ান শুনতে মাহফিলে লাখো মানুষের ঢল নামতো। তথ্য ও যুক্তিনির্ভর বক্তব্য, ভিন্ন ধারায় চুলচেরা বিশ্লেষণ, নির্ভীক ও প্রমিত উচ্চারণ এবং প্রাঞ্জল ও সাবলীল উপস্থাপনার মাধ্যমে আল্লামা সাঈদী এই তাফসির মাহফিলে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছেন। যে কারণে এই মাহফিল চালু হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর মানুষের ঢল বাড়তে থাকে। মূলত এই মাহফিলের মাধ্যমে আল্লামা সাঈদী দেশ-বিদেশে খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের কর্মকর্তারা বলছেন, সুশিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী বর্তমান সময়ে দেশের ধার্মিক তরুণদের আইডল। এ ইসলামিক স্কলার সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বয়ান করে অল্প সময়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেন। তাফসির মাহফিলের মাধ্যমে তার খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে যাবে।
২০০৬ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি প্যারেড ময়দানে সর্বশেষ তাফসীর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পরের দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই মাহফিলের অনুমতি দেয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার তাফসীর মাহফিল আয়োজনের চেষ্টা করে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ। ওই বছরের ২৯ মার্চ থেকে তাফসীর মাহফিল আয়োজনের প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। কিন্তু ওই দিন সরকারের নির্দেশে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) প্যারেড ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে। এরপর থেকে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় ঐতিহাসিক এই আয়োজন।
তাফসীর মাহফিল বন্ধ করেও ক্ষান্ত হয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৩ সালের ৩০ মে এই মাহফিলের আয়োজক সংস্থা প্যারেড ময়দান সংলগ্ন ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদের কার্যালয়ও উচ্ছেদ করে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে প্যারেড ময়দানে তাফসীর মাহফিল বন্ধের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। আশির দশক জুড়ে আল্লামা সাঈদীর এই তাফসীর মাহফিলের বিরোধিতা করে রাজপথে সরব ছিলেন তিনি।
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ চট্টগ্রাম নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে প্রথম তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের আয়োজন করে। এক বছর পর সেখান থেকে সরিয়ে কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে এই মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এরপর এই মাহফিলের আসর বসে লালদীঘি মাঠে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি বছর চকবাজারের প্যারেড ময়দানে পাঁচ দিনব্যাপী এই মাহফিল শুরু হয়।
প্রতি বছরে প্যারেড ময়দানে সাঈদীর এই মাহফিলে লাখো মানুষের সমাগম হতো। এতে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসতেন। অমুসলিমরাও এই মাহফিলে অংশ নিতেন।
জানা গেছে, ২৯ বছর ধরে চলা এই তাফসীর মাহফিলে অন্তত পাঁচ শতধিক অমুসলিম মুসলমান হয়েছেন।
ইসলামী সমাজ কল্যাণ পরিষদ আশা করছে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর পুনরুজ্জীবিত হতে যাওয়া এই তাফসীর মাহফিলে এবার লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হবে।
আরও পড়ুন: ৬ কোটি টাকার মালিক চিটাগাং চেম্বারের সেক্রেটারি