রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৬ অক্টোবর, ২০২৪ ১১:০২ : পূর্বাহ্ণ
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি রহস্যময় হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। নির্বাচনের এক বছর আগে হিসাবটি খুলে জমা করা হয় নগদ টাকা। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে এসে শুরু হয় নগদ টাকা উত্তোলন। এভাবে এই হিসাব থেকে নির্বাচনের আগেই উত্তোলন করা হয় প্রায় ৭২ কোটি টাকা। ব্যাংকের বনানী শাখায় হিসাবটি খোলা হলেও নগদ টাকার বেশির ভাগ উত্তোলন করা হয়েছে প্রধান কার্যালয়ের নিচে থাকা গুলশান শাখা থেকে।
ইউনিয়ন ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় এ তথ্য মিলেছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিয়ন ব্যাংকের বনানী শাখায় ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর মোস্তাক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই হিসাব খোলা হয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২০ আগস্ট হিসাবটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাংকটির অনলাইন তথ্যভান্ডার থেকে এই হিসাবে সব তথ্য গায়েব করে ফেলা হয়। যদিও হিসাব বন্ধ হলেও তথ্য মুছে ফেলার সুযোগ নেই। হিসাবের তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে, এমন হিসাবের সংখ্যা ইউনিয়ন ব্যাংকে আরও রয়েছে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
এ ছাড়া রহস্যময় এই হিসাবের নামে ইউনিয়ন ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে ৫৫ কোটি টাকা ঋণও দেওয়া হয়েছিল। এই ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যে ঠিকানা ব্যবহার করে মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাব খোলা হয়, সেই ঠিকানায় এই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে জানা গেছে।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এমন অনেককে ও তাদের পক্ষের ব্যক্তিদের তারা নির্বাচনের আগে এই হিসাব থেকে টাকা তুলতে দেখেছেন। ক্রিকেট থেকে চলচ্চিত্র তারকা, নবীন থেকে প্রবীণ প্রার্থীরাও ছিলেন এই তালিকায়। তাদের ধারণা, নির্বাচনের খরচ চালাতে এটা ছিল তৎকালীন সরকারের উপহার, যে খরচ দেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। এ জন্য ইউনিয়ন ব্যাংকসহ তার মালিকানায় থাকা আরও ব্যাংক থেকে এমন বেনামি ঋণ নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউনিয়ন ব্যাংক ‘ব্যাংক খেকো’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এস আলম নিয়ন্ত্রিত আরও কয়েকটি ব্যাংকের পাশাপাশি ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব ব্যাংক এখন তারল্যসংকটে ভুগছে। গ্রাহকদের অনেকে তাদের আমানতের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কথিত মোস্তাক ট্রেডার্সের হিসাবের ব্যাপারে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর বক্তব্য জানতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে একাধিকবার গেলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি। মোবাইল ফোনেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই বেনামি হিসাবটি নির্বাচনের কাজের জন্য খোলা হয়েছিল, সেই কাজে ব্যবহারও হয়েছে। ব্যাংক এমডির নির্দেশ ছাড়া এমন হিসাব খোলা ও বন্ধ হতে পারে না। তদন্ত করে দেখতে হবে কারা এই হিসাব থেকে টাকা নিয়েছে। আইনি পথে সেই টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনই সময় যারা এসব অপকর্মে জড়িত ছিল, তাদের আটকে ফেলা। তারা পালিয়ে গেলে তথ্য পাওয়া যাবে না, টাকা আদায়ে আইনি পথেও এগোনো যাবে না।’
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ২০১২ সালে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়। সব কটিই রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক একটি। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের পেছনে শুরু থেকে এস আলম গ্রুপ থাকলেও সামনে রাখা হয় জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকে।
তখন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এক জোট হয়ে সরকারে ছিল। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন এস আলমের ভাই শহীদুল আলম। ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর। বিভিন্ন সময় চেয়ারম্যান ও পরিচালক ছিলেন সাইফুল আলমের ভাই রাশেদুল আলম, ওসমান গনি, সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম ও জামাতা বেলাল আহমেদ।
ব্যাংকটির এমডি মোকাম্মেল হক চৌধুরী ব্যাংক দখল, অর্থ লুটপাট ও অর্থ পাচারে সাইফুল আলমের সহযোগী হিসেবে পরিচিত।
গত ২৭ আগস্ট আগে পর্ষদ বিলুপ্ত করে নতুন পর্ষদে চেয়ারম্যান করা হয় এক্সিম ব্যাংকের সাবেক এমডি মু. ফরীদ উদ্দিন আহমদকে।
আরও পড়ুন:
এস আলম গ্রুপের তথ্য চেয়েছে সিঙ্গাপুরের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা
এস আলমের বিরুদ্ধে ১ লাখ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ, তদন্তে সিআইডি
‘পৃথিবীতে এস আলমের মতো কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেনি’