রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ৬:১৫ : অপরাহ্ণ
দুই বছর আগে নাহিদ ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিসিস (গবেষণামূলক নথি) দিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। যে থিসিসে দেখানো হয়েছিল ‘কেন বাংলাদেশের কোনো ছাত্র আন্দোলন কখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি।’ সেই থিসিসের উপসংহার কী ছিল, তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, তাতে কিছু যায় আসে না। ২৬ বছর বয়সী এই যুবক এবার ইতিহাস বদলে দিয়েছেন। দেশব্যাপী শুরু হওয়া গণবিক্ষোভে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের একজন হিসেবে বিবেচিত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্র আন্দোলনের আলোচিত মুখ ছিলেন নাহিদ ইসলাম।
সেপ্টেম্বরের এক রোববার বিকেলে ঢাকার তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে একটি বিলাসবহুল কালো চামড়ার চেয়ারে বসে থেকে শান্ত কণ্ঠে নাহিদ ইসলাম টাইম ম্যাগাজিনকে বলেছিলেন, ‘হাসিনা একজন রক্তচোষা এবং সাইকোপ্যাথ (মানসিক রোগী)।’
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, তিনি তথ্য-প্রযুক্তি পড়াতেন (প্রাইভেট শিক্ষক)। সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার এড়াতে তাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন তিনি দেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উপদেষ্টা।
জুন মাসে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে নাহিদ ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ঢুকে প্ল্যাকার্ড হাতে মানুষদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অবদান রাখা প্রবীণদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরি পাওয়ার সুবিধা দিয়ে বিতর্কিত কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্ট। নাহিদ ও তার সহপাঠীরা কোটা পুনর্বহালের পরিবর্তে সবার জন্য ন্যায্য সুযোগ দাবি করেন।
প্রথম ২০১৮ সালে কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে করা আন্দোলনটি সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো উত্তাল করে তোলে। সে সময় সরকার শেষ পর্যন্ত তার অবস্থান থেকে পিছু হটে এবং বিক্ষোভ থেমে যায়। এ বছরও কোটাপদ্ধতির বিষয়টি শেষ হতে পারত বলে মনে করেন নাহিদ।
কিন্তু এরপর নিরাপত্তাবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর সরাসরি গুলি ছুড়তে শুরু করে। ১৬ জুলাই দু’হাত বাড়িয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আরেক ছাত্রনেতা আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
নাহিদ বলছিলেন, ‘আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরে এই বিক্ষোভ দ্রুত দেশজুড়ে জনসংখ্যার বিশাল অংশে ছড়িয়ে যায়, যা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের মুখে ক্রমবর্ধমান হতাশার প্রতিফলন।’
শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা স্বয়ং শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করেই মনোনিবেশ করেন। ৩ আগস্ট শিক্ষার্থীরা যখন এক দফা দাবি নিয়ে জড়ো হন, তখন নাহিদ ইসলামই ঘোষণা দেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ ঘোষণা করেন। এরপর ৫ আগস্ট, যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকার কেন্দ্রস্থলে হাসিনার বাসভবনের কাছাকাছি এসেছিল, তখন তিনি ভারতে উড়াল দেন।
চামড়ার বড় চেয়ারে এদিক ওদিক দুলতে দুলতে ইসলাম বলেন, ‘কেউ ভাবেনি হাসিনার শাসন উপড়ে ফেলা যাবে।’
সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ১৭ কোটি মানুষের দেশের দায়িত্বে থাকা ছাত্ররা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে (৮৪) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করতে বলেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণা দিয়ে উন্নয়ন শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে খ্যাতি অর্জন করা এই অর্থনীতিবিদ হাসিনা সরকারের আরোপিত একাধিক আইনি অভিযোগের কারণে নিজেই নির্বাসনে ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ইউনূস এখন নাহিদ ইসলামের বস-ছাত্ররা এভাবেই চেয়েছিল। কে কার কাছ থেকে নির্দেশ নিচ্ছে, জানতে চাইলে ইসলাম মুচকি হেসে বলেন, ‘ড. ইউনূস সব বড় সিদ্ধান্তে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন।’
তিনি মন্ত্রণালয়ে তার ডেস্কে রাখা একটি লাল ল্যান্ডলাইনের দিকে ইঙ্গিত করেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ভিআইপি ফোন। আমি আসলে জানি না কেনো এটি এখানে ব্যবহার করা উচিত! আমি তো ড. ইউনূসকে হোয়াটসঅ্যাপেই টেক্সট করি।’
সমাজবিজ্ঞানের এই স্নাতক বরাবরই সরকারের বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ছিলেন। ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী এক শিক্ষকের এই ছেলে ভারত সীমান্তে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রান্তে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন। ২০১৯ সালে নাহিদ ক্যাম্পাস নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং পরে তার সহকর্মীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র সংগঠনে ছিলেন।
এ বছরের জুলাই মাসে নাহিদ প্রথম জনগণের কাছে পরিচিতি পান, যখন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাকে তুলে নেয় ও নির্যাতন করে। এক উত্তপ্ত রাতে প্রায় ৩০ জন সাদা পোশাকের অফিসার তার এক বন্ধুর বাড়িতে হাজির হয়েছিল, যেখানে তিনি বিক্ষোভে ভূমিকার জন্য গ্রেপ্তার এড়াতে লুকিয়ে ছিলেন।
নাহিদ জানান, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তার মাথায় কালো কাপড় পরিয়ে দিয়েছিল, তারপর তারা তাকে বলেছিল ‘তুমি আর কখনো পৃথিবী দেখতে পাবে না।’
নাহিদ ইসলামকে একটি গোপন কারাগারে রাখা হয়। তার হাত ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে। তাকে গোয়েন্দারা ‘মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা আসছে কোথা থেকে?’ এসব জিজ্ঞাসা করেন। পরে তাকে একটি সেতুর পাশে ফেলে দেওয়া হয়। তার শরীরে আঘাতের ছবি স্থানীয় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
নাহিদ বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের আন্দোলনের নেতার জন্য পরিচিত মুখ খুঁজছিল, কিন্তু আমরা শুধু একজন ছিলাম না। এটাই ছিল আমাদের মূল শক্তি।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেওয়াটা ছিল একটি দলবদ্ধ কাজ। মিডিয়া সর্বদা একটি মুখ চায়, তবে আমি এই আন্দোলনের একমাত্র নেতা নই। আমরা অনেকেই ছিলাম।’
দেশে রদবদলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। এই নতুন বাংলাদেশে, একজন স্বৈরশাসকের হাত থেকে মুক্তির পথ দেখানো ছাত্রদের কাছ থেকে সবাই কেবল সেরাটাই প্রত্যাশা করে, যেমনটা এখন অনেকে প্রকাশ্যে বলার সাহস রাখে।
ভোট কারচুপি, সমালোচকদের ওপর দমন-পীড়ন এবং সাধারণ ভীতির পরিবেশের কারণে ১৫ বছরের শাসনের পর ছাত্রদের সাফল্যে বাংলাদেশিরা উজ্জীবিত। মানুষ এখন তাদের নতুন স্বাধীনতাকে কাজে লাগাচ্ছে। শ্লীলতাহানির প্রতিবাদে নারীরা বিক্ষোভ করছেন। শিক্ষার্থীরা কয়েক সপ্তাহ বিঘ্নিত ক্লাসের পরে স্থগিত হওয়া পরীক্ষার বিরোধিতা করে। এমনকি ঢাকার স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে- তারা তাদের অধ্যক্ষকে পছন্দ করে না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে মানুষ কথা বলতে পারেনি, অবশেষে তারা সুযোগ পেয়েছে।’
তবে তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়তো সামনে। দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তির ঢেউ থাকলেও উদযাপনের সময় আসেনি। আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়। আর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ঐতিহ্যগতভাবে সহিংসতায় জর্জরিত হওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
নাহিদ বলছেন, ‘আমরা এখানে অল্প সময়ের জন্য থাকবো। দুর্নীতি, সহিংসতা- মানুষ আর এসব দেখতে চায় না। আমাদের নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
আরও পড়ুন: কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন