রাজনীতি সংবাদ প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি প্রকাশের সময় :২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ২:০৮ : অপরাহ্ণ
খাগড়াছড়িতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান, ভাঙচুর করা হয় বাড়িঘরে।
নিহত তিনজন হলেন-ধন রঞ্জন চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০)। এর মধ্যে ধন রঞ্জন চাকমা দু’পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অপর দু’জন রুবেল ত্রিপুরা ও জুরান চাকমা (২০) জেলা সদরের নারানখাইয়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন।
খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রিপল বাপ্পি চাকমা জানান, আহতদের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। অপর দুজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান।
স্থানীয়রা বলেন, বুধবার সকালে চুরির অভিযোগে ‘গণপিটুনিতে’ মামুন নামে এক যুবক হত্যার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল বের করে দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলের এক পর্যায়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। পরে লারমা স্কয়ারের দোকানপাটে আগুন দেয় একপক্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের গুজবকে কেন্দ্র করে দীঘিনালা সদরের বাঙালি অধ্যুষিত থানা বাজার ও বোয়ালখালী বাজারের বাসিন্দাদের মধ্যে ভয় ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ দুই বাজারের মাঝখানের লারমা স্কয়ার এলাকায় খাগড়াছড়িতে সংঘটিত গণপিটুনি নিয়ে বেশ কয়েকজনের মধ্যে বচসা হয়। এর পর বিকেল ৪টার দিকে জনা পঞ্চাশেক বাঙালি মিছিল নিয়ে কলেজ গেট থেকে থানা বাজার ঘুরে লারমা স্কয়ারের দিকে এগোলে পাহাড়িরা বাধা দেয়। দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা লারমা স্কয়ারে সওজের জায়গায় স্থাপিত অস্থায়ী মার্কেটে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় বেশ কয়েকটি ফাঁকা গুলির শব্দ হলে বাঙালিরা পিছু হটে।
সন্ধ্যার পর থেকে দীঘিনালা,পানছড়িসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার অবরোধ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চড়াও হয়। পানছড়িতে বিক্ষোভকারীরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে।
রাতে জেলা সদরের নারানখাইয়া ও স্বনির্ভর এলাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনা যায়। কারা গুলিবর্ষণ করেছে কেউ নিশ্চিত না করলেও এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গভীর রাতে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। দুই পাহাড়ি যুবক ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে জুরান চাকমাকে (২০) মৃত অবস্থায়, রুবেল ত্রিপুরা (৩৫) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
হাসপাতালে চিকিসাধীন আহত ও তাদের অভিভাবকরা জানিয়েছেন, জেলা সদরের নারাখাইয়া এলাকায় কয়েকজনকে আটক করলে তারা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে তারা গুলিবিদ্ধ হন।
পুলিশের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়লে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামেন। ততক্ষণে মার্কেটের অধিকাংশ দোকান পুড়ে যায়। ওই মার্কেটে পাহাড়ি-বাঙালি উভয় পক্ষের দোকানপাট রয়েছে।
গত বুধবার ভোরে খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়ায় চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামে এক যুবদল কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় বিএনপি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, এ ঘটনা নিয়ে বুধবার রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঙালি ও পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে অনেকটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে দীঘিনালায় সংঘাত ঘটানোর উস্কানি দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বর্তমানে পুরো জেলায় জনমনে আতঙ্ক ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কের বিভিন্ন স্থানে উত্তেজিত পাহাড়ি লোকজন রাস্তায় গাছ কেটে এবং চেঙ্গী নদীর জন্য নির্মিত ব্লক ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। ফলে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িতে নিরাপত্তাবাহিনীকে টহল দিতে দেখা যাচ্ছে।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান বলেন, ‘রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
আরও পড়ুন: হাসিনার পালানোর দৃশ্য দেখে সেদিন যা বলেছিলেন খালেদা জিয়া