রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, ঢাকা প্রকাশের সময় :৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ৮:৩০ : অপরাহ্ণ
ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম গোপনে দেশ ছেড়েছেন। তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চলে যান।
ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, মাহবুবুল আলম ব্যাংককে যাওয়ার পর সেখান থেকে ফোনে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব বুঝে দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির প্রতিনিধি আমিন হেলালী বিষয়টি নিশ্চিত করে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘তিনি (মাহবুবুল আলম) নাকি চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে গিয়েছেন। তিনি আমাকে ফোন করে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলেছেন। কিন্তু তিনি কবে ফিরবেন সে বিষয়ে কিছু জানাননি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য রাজনীতি সংবাদকে বলেন, এফবিসিসিআইয়ের সদস্যদের একাংশ তার (মাহবুবুল আলম) পদত্যাগের দাবি তোলার কারণে তিনি চাপের মুখে পড়েছেন। এ কারণে পদত্যাগ না করতে সময়ক্ষেপণ করার উদ্দেশ্যে কৌশলে অসুস্থতার কথা বলে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
তবে এর আগে গত ২০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠকে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২২ আগস্ট আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাতে তিনি এফবিসিসিআই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
গত ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এফবিসিসিআই ঘিরে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসে।
এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি জানিয়ে গত ১৮ আগস্ট অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে চিঠি দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি আবুল কাসেম হায়দারসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।
ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ১৫ বছরে এফবিসিসিআইয়ের কার্যক্রম ব্যবসা, শিল্প–বাণিজ্য ও সেবা খাতের স্বার্থে পরিচালিত হয়নি। বরং অনির্বাচিত, একদলীয় স্বৈরাচারী সরকারের তোষামোদি, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলসহ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিল। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কিছু অসাধু, অব্যবসায়ী পর্ষদের নেতৃত্বে এসে এফবিসিসিআই অফিসকে দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছে। বিভিন্ন বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে তারা দেশের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
এ ছাড়া গত ৪ সেপ্টেম্বর ও ২১ আগস্ট এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি ও মানববন্ধন পালন করেছেন ফেডারেশনের সদস্যদের একাংশ।
গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনের সামনে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি আবুল কাশেম হায়দার বলেন, ‘সভাপতি মাহবুবুল আলম ও পর্ষদের বাকি সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। তারপর সরকারকে অন্তর্বর্তী প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দেবেন প্রশাসক।’
অবস্থান কর্মসূচিতে আলী আফজাল নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘গত ২২ জুলাই গণভবনে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, তৎকালীন সরকারের সঙ্গে থাকবেন। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমৃত্যু থাকার কথাও বলেন। আপনাদের নেত্রী দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এখন পদত্যাগ করে আপনারাও (এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদ সদস্য) নেত্রীর কাছে চলে যান।’
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছিলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী আপনার সাথে ছিলাম, আপনার সাথে আছি, আপনার সাথে থাকবো। আমরা প্রত্যেকটা ব্যবসায়ী আপনার পক্ষে আছি। এর কোনো বিকল্প আমরা চাই না। আপনার নেতৃত্বেই এ দেশ চলবে, অন্য কাউকে আমরা এখানে দেখতে চাই না, কারণ আপনি ব্যবসাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী।’
কিন্তু গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিনের মাথায় ভোল পাল্টে ফেলেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতার হাতে গত কয়েক দিনে এক অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এই বিপ্লবের ফলে ছাত্র-জনতার মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২ আগস্ট এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির চেয়ারে বসানো হয় মাহবুবুল আলমকে। তিনি আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য।
এর আগে মাহবুবুল আলম টানা চারবার বিনাভোটে শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির চেয়ারে বসেছিলেন। চট্টগ্রাম চেম্বারের চেয়ার ছাড়ার পর তিনি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতিও হন বিনাভোটে।
চট্টগ্রাম চেম্বারকে কব্জার রাখতে মাহবুবুল আলম গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে টানা পাঁচবার সভাপতির চেয়ার দখলে রাখেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেউ তিনবারের বেশি সভাপতি হতে পারবে না। কিন্তু মাহবুবুল আলম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বাণিজ্য সংগঠন (ডিটিও) উইয়েং গিয়ে তদবির করে তিনবারের সময়সীমা বাতিল করেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ হলে কপাল পুড়বে মাহবুবুল আলমের!
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগের পর সংগঠনটিতে কয়েক দিনের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগ দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সকল পরিচালক পদত্যাগ করেন।
গত ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম চেম্বারে গত ১৬ বছর ধরে ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগে ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ করেন। এ অবস্থায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ।
জানা গেছে, কয়েক দিনের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্ম সচিব কিংবা কোনো ব্যবসায়ীকে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রাম চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ হলে কপাল পুড়বে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমের! তিনি এফবিসিসিআই সভাপতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম চেম্বারের একজন সাধারণ সদস্য।
বাণিজ্য সংগঠন আইন-২০২২ এর ১৭ ধারার ৪ নম্বর উপ-ধারায় উল্লেখ আছে-কোনো বাণিজ্য সংগঠনের প্রশাসক নিযুক্ত থাকাকালীন উক্ত সংগঠনের কোনো সদস্য ফেডারেশনের নির্বাচনে প্রার্থী বা ভোটার হইতে পারিবেন না এবং ফেডারেশনের সাধারণ পরিষদে উক্ত সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব স্থগিত থাকিবে।
ফলে চট্টগ্রাম চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ হওয়ার পর মাহবুবুল আলমকে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির চেয়ার ছাড়তে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বাণিজ্য সংগঠনের (ডিটিও) সিনিয়র সহকারী সচিব অমিত দেব নাথ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘বিষয়টা আমরা খতিয়ে দেখছি। বাণিজ্য সংগঠন আইন অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি যেহেতু চট্টগ্রাম চেম্বারের সাধারণ সদস্য, তাই সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে আর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ অবস্থায় এফবিসিসিআইয়ে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। কারণ অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে ব্যবসায়ীরা এফবিসিসিআইয়ে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রের’ কবল থেকে মুক্ত হলো চট্টগ্রাম চেম্বার