মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ২ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১৩ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

আন্দোলনকারী ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগ

‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রের’ কবল থেকে মুক্ত হলো চট্টগ্রাম চেম্বার


রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ৫:৩১ : পূর্বাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রের’ কবল থেকে অবশেষে মুক্ত হলো শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। আন্দোলনকারী ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদের সকল পরিচালক পদত্যাগ করেছেন।

পদত্যাগ করা ২৪ জন পরিচালকের পদত্যাগপত্র আজ সোমবার সন্ধ্যার মধ্যেই ই-মেইলের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বাণিজ্য সংগঠনের (ডিটিও) মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হবে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সচিব প্রকৌশলী মো. ফারুক রাজনীতি সংবাদকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে গতকাল রোববার বিকেলে চট্টগ্রাম চেম্বারে পরিচালনা পর্ষদ বৈঠক বসে। মূলত পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে এই বৈঠক ডাকেন চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ। বৈঠকে অংশ নেওয়া পরিচালকরা সবাই পদত্যাগ করতে সম্মত হন। আজ সোমবারের মধ্যেই সকল পরিচালককে পদত্যাগপত্র জমা দিতে আহ্বান জানানো হয়।

জানা গেছে, পরিচালকরা পদত্যাগ করায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিও চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে দেবে। এরপর চট্টগ্রাম চেম্বারে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে। কয়েক দিনের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে একজন যুগ্ম সচিব কিংবা কোনো ব্যবসায়ীকে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

১১৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই চেম্বার থেকে প্রথম পদত্যাগের ঘটনা ঘটে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর। নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্যাসিফিক জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর পরিচালক থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। চেম্বারে এম এ লতিফের স্বেচ্ছাচারিতা ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সৈয়দ তানভীর পরিচালক পদ ছেড়ে দেওয়াতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন।

আন্দোলনকারী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর-পতেঙ্গা) আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম গত ১৬ বছর ধরে চেম্বারকে কব্জার রেখেছিলেন। তারা চেম্বারে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।

গত ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম চেম্বার ঘিরে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসে। চেম্বারে ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করার অভিযোগে গত ১৮ ও ২৫ আগস্ট নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ পরিস্থিতিতে গত ২৮ আগস্ট চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন ও পরিচালক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর পদত্যাগ করেন।

এরপর গতকাল রোববার একসঙ্গে ১০ জন পরিচালক পদত্যাগ করেন। বাকি ১২ জন পরিচালক আজ পদত্যাগ করলেন।

পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা হলেন-সভাপতি ওমর হাজ্জাজ, সিনিয়র সহসভাপতি তরফদার রুহুল আমিন, সহসভাপতি রাইসা মাহবুব, পরিচালক এ কে এম আকতার হোসেন, অহীদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী আলমগীর, অঞ্জন শেখর দাশ, মাহফুজুল হক শাহ, বেনজির চৌধুরী নিশান, আলমগীর পারভেজ, নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন, ইঞ্জিনিয়ার ইফতেখার হোসেন, গাওহার সিরাজ জামিল, আকতার পারভেজ, মাহবুবুল হক মিয়া, রেজাউল করিম আজাদ, আদনানুল ইসলাম, মনির উদ্দিন, আখতার উদ্দিন মাহমুদ, সাজ্জাদ উন নেওয়াজ, ওমর মুক্তাদির এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

পরিচালকরা পদত্যাগ করায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন আন্দোলনকারী ব্যবসায়ীরা।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ আগস্ট বিনাভোটে ওমর হাজ্জাজের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত হয়। গত ৯ বছর ধরে চেম্বারের ভোট হয়নি।

সর্বশেষ ভোটাভুটি হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ সমর্থিত মাহবুবুল আলম-নুরুন নেওয়াজ সেলিম পরিষদ জয়লাভ করে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো মোরশেদ-সালাম ঐক্য পরিষদ।

এর পরের পাঁচ মেয়াদের নির্বাচনে কোনো ভোটাভুটি হয়নি।

অভিযোগ আছে, এম এ লতিফের ম্যাকানিজমের কারণে গত ৯ বছর ধরে চেম্বারের ভোট হয়নি। চেম্বারের ৬ হাজার ৬২৩ জন ভোটারের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার ভুয়া ভোটার রয়েছে। এসব ভুয়া ভোটারকে লতিফ অবৈধভাবে চেম্বারের সদস্যপদ দিয়েছেন। লতিফের এসব ভুয়া ভোটারের কারণে গত পাঁচটি নির্বাচনে তার প্যানেলের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।

ভোট না হওয়ার কারণে চারবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতির চেয়ারে বসেন মাহবুবুল আলম।

বিস্ময়কর বিষয় হলো, চেম্বারকে কব্জার রাখতে মাহবুবুল আলম গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে টানা পাঁচবার সভাপতির চেয়ার দখলে রাখেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেউ তিনবারের বেশি সভাপতি হতে পারবে না। কিন্তু মাহবুবুল আলম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বাণিজ্য সংগঠন (ডিটিও) উইয়েং গিয়ে এম এ লতিফের মাধ্যমে তদবির করে তিনবারের সময়সীমা বাতিল করেন।

২০০৮ সালে এম এ লতিফ চেম্বারের সভাপতি হওয়ার পর শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে কব্জায় নেয়। তার সঙ্গে হাত মেলান মাহবুবুল আলম। এরপর তারা চেম্বারে ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেন।

চেম্বারের সদ্য পদত্যাগ করা পরিচালনা পর্ষদের ২৪ জন পরিচালকের মধ্যে ছয়জন নিকটাত্মীয়কে বিনাভোটে পরিচালক পদে বসিয়েছিলেন এম এ লতিফ। এরা হলেন দুই ছেলে-সভাপতি ওমর হাজ্জাজ ও পরিচালক ওমর মুক্তাদির, লতিফের ভাগিনা আদনানুল ইসলাম, লতিফের মেঝো সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) মেয়ের জামাই মনির উদ্দিন, লতিফের ভাগ্নি জামাই আবু সুফিয়ান চৌধুরী এবং লতিফের বড় সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) মেয়ের জামাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম তার মেয়ে রাইসা মাহবুবকে সহসভাপতি ও ভাই আলমগীর পারভেজকে পরিচালকের চেয়ারে বসান।

আরও পড়ুন:

চট্টগ্রাম চেম্বারের সঙ্গে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের সমঝোতার গুঞ্জন

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজের কর ফাঁকি!

‘চাপে’ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স দিলো চট্টগ্রাম চেম্বার

চট্টগ্রাম চেম্বারে এমপি লতিফের পরিবারতন্ত্রের জালে সৈয়দ নজরুল

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর