শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা রাজধানী

এখনো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তারা


কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, ঢাকা প্রকাশের সময় :৩০ আগস্ট, ২০২৪ ১০:০১ : পূর্বাহ্ণ

এখনো অপেক্ষার প্রহর গুনছেন গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা। গুমের শিকার ব্যক্তিদের তথ্য অবিলম্বে পরিবারকে জানানোর দাবি জানিয়েছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে করা মানববন্ধন থেকে এই দাবির কথা জানায় সংগঠনটি।

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছরের শাসনামলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরে পেতে এবং গুমের সঙ্গে জড়িত সবার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ওই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

এই কর্মসূচিতে অংশ নেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও নিখোঁজদের স্বজনরা। তাদের অনেকের হাতে স্বজনের ছবি ছিল। কথা বলতে গিয়ে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনো দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনো পরিবারের কাছে আসছে না।’

১১ বছর ধরে ছেলের অপেক্ষায় আয়েশা আলী। ২০১৩ সালে ছেলে আব্দুল কাদের মাসুম গুম হয়। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাননি। এতো বছরেও ছেলেকে হারানোর শোক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না তার।

আয়েশা আলী বলেন, ‘গুমের সরকার পালিয়ে চলে গেছে। দেশ আবার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে এখনো ঘরে ফেরেনি। আমার ছেলে মাসুমের জন্য কি দেশ স্বাধীন হয়নি?’

ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে তার ফেরার অপেক্ষায় থাকা এই মা বলেন, ‘আমার ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে এই আশা ছিল। কিন্তু গত ১১ বছর ধরে তার অপেক্ষায়। তার একটি প্যান্ট আমি এখনো আগলে রেখেছি। সে কখন এসে বলবে-মা আমার প্যান্টটা দাও।’

নিখোঁজ ইসমাইল হোসেন বাতেনের মেয়ে আনিশা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘আমার বাবা জীবিত নাকি মৃত সেটা অন্তত আমি জানতে চাই। যারা মারা যায়, তাদের কবর জিয়ারত করা যায়, কিন্তু আমরা এমনই হতভাগা, আমরা জানি না আমাদের বাবা জীবিত নাকি মৃত। আমি আমার স্কুলের কোনো কাজে বাবার সিগরেচার দিতে পারি না। নামের শুরুতে জীবিত না মৃত কিছুই লিখতে পারি না।’

২০১২ সাল থেকে নিখোঁজ পল্লবী থানার ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক তরিকুল ইসলাম তারা।

মানববন্ধনে তার বাবা নূরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে আমার ছেলেকে গুম করা হয়েছে। এতদিন আমরা রাস্তায় দাঁড়াতে পারি নাই। প্রেস ক্লাবে একদিন বক্তব্য দেয়ায় আমাকে দু’দিন গুম করার চেষ্টা করেছে। এলাকাবাসী মাইক দিয়ে ডাকাত আসছে ঘোষণা করায় তারা আমাকে নিতে পারে নাই। সন্তান হারিয়ে আমি আজ অসহায়। নতুন সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।’

২০১০ সালের ২৪ জুন রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার চৌধুরী আলমকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দেয়া লোকজন। চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আখতার মুক্তা বলেন, ‘বাবা হারিয়ে আমরা পাগলপ্রায়। তারপরও আমরা রাস্তায় এসে দাঁড়াই, যদি আমার বাবার সন্ধান পাই। স্বাধীন দেশে গুম বলে কিছু থাকতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।’

২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক সংগঠন ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মানববন্ধনে মাইকেল চাকমা বলেন, ‘আমাকে ৫ বছর তিন মাস গুম করে রাখা হয়েছিল। আলো-বাতাসহীন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। এই কষ্টটা আমি জানি। দিনের পর দিন সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়েছে। এটা শুধু বেঁচে থাকা নয়, অনেকটা মৃত্যুর মতো। এটা বুঝি, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার কতো কষ্টে দিন কাটায়। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আমলে কোনো ডেমোক্রেসি ছিল না। মানবাধিকার ছিল না, মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। এই হাসিনার গত ১৫ বছরে যে গুম-খুন করেছে, তার একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার হতে হবে।’

মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতোটা অমানবিক ছিল। আমি ২৩ ঘণ্টা গুম ছিলাম, দুই মাস জেলে ছিলাম। সে সময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে। গুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে, তার ৯৫ শতাংশের মতো সঠিক, শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কিনা জানি না।’

তিনি বলেন, ‘এই জুলাইয়ে কতোগুলো মানুষ মারা গেছে। হয়তো হাজারের বেশি, আমরা বলতে চাই তাদের হত্যারও বিচার করতে হবে। যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে, সরকারকে যেতে হবে। আমরা যে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সে বাংলাদেশে সকল মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘গুম শব্দ নেই বলে বিচার করা যাবে না, এটা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মুখ বন্ধ ছিল। আদালত এই ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। কোনো হস্তক্ষেপ আমরা দেখিনি।’

আরও পড়ুন: আরাফাতকে সীমান্ত পার করে দেওয়ার চেষ্টা

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর