রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২৮ আগস্ট, ২০২৪ ৩:১৫ : অপরাহ্ণ
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ গোপনে সমঝোতা করেছেন বলে ব্যবসায়ী মহলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। সমঝোতার অংশ হিসেবে চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজসহ পরিচালনা পর্ষদের ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করবেন এবং এসব শূন্যপদে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের কো-অপ্ট (সভায় সদস্য নির্বাচন করা) করা হবে।
শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সকে ‘স্বৈরশাসন ও পরিবারতন্ত্র’ থেকে মুক্ত করার দাবিতে গত ১৮ আগস্ট নগরীর আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের একাংশ। সমাবেশ থেকে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালকদের পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।
‘চট্টগ্রামের সকল ব্যবসায়ী সমাজ’ ব্যানারে এ বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নুরুল হক। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এস এম ফজলুল হকের ভাই।
এর পর গত ২৫ আগস্ট বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের আরেকটি অংশ আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
‘বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরাম’ ব্যানারে এ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন এস এম সাইফুল আলম। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। এই কর্মসূচি থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের ‘অবৈধ’ কমিটি অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানানো হয়।
জানা গেছে, বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের দুটি অংশের আন্দোলনের কারণে অচল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রশাসনিক কার্যক্রম। সভাপতি থেকে শুরু করে পরিচালকদের কেউ চেম্বারে আসছেন না।
চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট। তাই শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর চেম্বারের পরিচালকরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
চেম্বারকে নিয়ন্ত্রণ করতেন চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর-পতেঙ্গা ) আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম। এর মধ্যে গত ১৬ আগস্ট পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এম এ লতিফ। এরপর তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখন তিনি কারাগারে বন্দি।
এদিকে চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে একলাফে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির চেয়ারে বসা মাহবুবুল আলমও বিপাকে পড়েছেন। কারণ এফবিসিসিআইয়ের কমিটিও ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে মাহবুবুল আলম তার সভাপতির চেয়ার রক্ষা করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম চেম্বারের এখন টলমল অবস্থা।
তাহলে এখন কোন পথে হাঁটছে চট্টগ্রাম চেম্বার?
জানা গেছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালকদের অনেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর মধ্যে আজ বুধবার দুপুরে পদত্যাগ করেছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি ও সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন। আরও কয়েকজন পরিচালক পদত্যাগ করতে পারেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম চেম্বারের একজন পরিচালক রাজনীতি সংবাদকে বলেন, বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের কারণে আমরা এখন সংকটের মধ্যে পড়েছি। চেম্বার এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আমাদের পদ নিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আমিসহ কয়েকজন পরিচালক চেম্বার সভাপতিকে এই সংকট সমাধানে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলেছি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নুরুল হকের নেতৃত্বে বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ চেম্বারের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। চেম্বারের পক্ষ থেকেও এই সমঝোতার প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, চেম্বারের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে এম এ লতিফ ও মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। সমঝোতার অংশ হিসেবে চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজ, সহসভাপতি রাইসা মাহবুবসহ লতিফ-মাহবুবের নিকটত্মীয়রা সবাই পদত্যাগ করবেন। যাতে চেম্বারকে পরিবারতন্ত্রমুক্ত বলা যায়। সবমিলিয়ে পরিচালনা পর্ষদের ১০ জন সদস্য পদত্যাগ করবেন।
সূত্রটি জানিয়েছে, বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কো-অপ্টের মাধ্যমে চেম্বারের সভাপতি হিসেবে এস এম নুরুল হকের নাম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে এস এম নুরুল হক রাজনীতি সংবাদের কাছে সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা যেখানে চেম্বারের পরিচালকদের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছি, সেখানে তাদের সঙ্গে কেন সমঝোতা করবো? এটা আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপিপন্থি ‘বঞ্চিত ব্যবসায়ী ফোরাম’ নামের অপর একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের সমন্বয়ক এস এম সাইফুল আলম বলেন, ‘চেম্বারের সামনে পথ খোলা আছে একটা-সকল পরিচালকের পদত্যাগ। এর বাইরে চেম্বার অন্য পথে হাঁটলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। কো-অপ্টের মাধ্যমে আমরা কাউকে চেম্বার দখল করতে দেবো না। যারা গত ১৫ বছর ধরে চেম্বারকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে লুটপাট করেছে তাদের বিচার আমরা অবশ্যই করবো।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ গোপনে চট্টগ্রাম চেম্বারের সঙ্গে সমঝোতা করলেও এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ এটা নির্ভর করছে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন চৌধুরীর সিদ্ধান্তের ওপর। তাকে উপেক্ষা করে এই সমঝোতা বাস্তবায়ন করলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চেম্বারের পুনর্বিন্যাস করা কমিটিও বাতিল হয়ে যেতে পারে।
সূত্রটি জানিয়েছে, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে এস এম নুরুল হক কয়েকদিন আগে আমীর হুমায়ুন চৌধুরীর সঙ্গে তার বাসায় সাক্ষাৎ করতে যান। কিন্তু আমীর হুমায়ুন চৌধুরী তার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন চৌধুরী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘নুরুল হক আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু আমি তার কথা শুনিনি। তারা লতিফের মতো পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে চেম্বার দখল করতে চায়। এরা ইলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারবে না বিধায় এই পথ বেছে নিয়েছে।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি চাই চট্টগ্রাম চেম্বারে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হোক। এরপর ভোটার তালিকা সংশোধন করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের একাংশের সঙ্গে চূড়ান্ত সমঝোতা না হলে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালকরা সবাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিওতে পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম চেম্বারে একজন প্রশাসক নিয়োগ দেবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চেম্বারের কমিটি বাতিলের বিষয়ে আমাদের কাছে এখনো পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে কোনো আবেদন করা হয়নি। যদি আবেদন করা হয় তাহলে বিষয়টি আমরা বিবেচনা করবো। আর চেম্বারের পরিচালকরা পদত্যাগ করলে আমরা সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেবো। ইতোমধ্যে আমরা দেশের কয়েকটি চেম্বারে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছি।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ৮ আগস্ট বিনাভোটে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ওমর হাজ্জাজ। তিনি চট্টগ্রাম-১১ আসনের আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের তৃতীয় সন্তান। চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান ২৪ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে লতিফের আরেক ছেলে ওমর মুক্তাদিরসহ আরও ছয়জন নিকটাত্মীয় রয়েছেন। এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম তার মেয়ে রাইসা মাহবুবকে সহসভাপতি এবং তার ভাই আলমগীর পারভেজকে পরিচালক পদে বসিয়েছেন। বাকি পরিচালকদেরও লতিফ-মাহবুব স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে চেম্বারের চেয়ারে বসিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সর্বশেষ ভোটাভুটি হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনে এম এ লতিফ সমর্থিত মাহবুবুল আলম-নুরুন নেওয়াজ সেলিম পরিষদ জয়লাভ করে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো মোরশেদ-সালাম ঐক্য পরিষদ।
এর পরের পাঁচ মেয়াদের নির্বাচনে কোনো ভোটাভুটি হয়নি। চারবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতির চেয়ারে বসেন মাহবুবুল আলম।
বিস্ময়কর বিষয় হলো, চেম্বারকে কব্জার রাখতে মাহবুবুল আলম গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে টানা পাঁচবার সভাপতির চেয়ার দখলে রাখেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেউ তিনবারের বেশি সভাপতি হতে পারবে না। কিন্তু মাহবুবুল আলম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক বাণিজ্য সংগঠন (ডিটিও) উইয়েং গিয়ে এম এ লতিফের মাধ্যমে তদবির করে তিনবারের সময়সীমা বাতিল করেন।
২০০৮ সালে এম এ লতিফ চেম্বারের সভাপতি হওয়ার পর শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানকে কব্জায় নেয়।
অভিযোগ আছে, এম এ লতিফের ম্যাকানিজমের কারণে গত ৯ বছর ধরে চেম্বারের ভোট হয়নি। চেম্বারের ৬ হাজার ৬২৩ জন ভোটারের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার ভুয়া ভোটার রয়েছে। এসব ভুয়া ভোটারকে লতিফ অবৈধভাবে চেম্বারের সদস্যপদ দিয়েছেন। লতিফের এসব ভুয়া ভোটারের কারণে গত পাঁচটি নির্বাচনে তার প্যানেলের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।
আরও পড়ুন:
চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ওমর হাজ্জাজের কর ফাঁকি!
‘চাপে’ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স দিলো চট্টগ্রাম চেম্বার
চট্টগ্রাম চেম্বারে এমপি লতিফের পরিবারতন্ত্রের জালে সৈয়দ নজরুল
শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম চেম্বারে কী হচ্ছে?